বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৭

দুরন্ত ষাড় আর একশ একটি নীল পদ্মের টানে



তখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি, নটরডেম কলেজের কড়া শাসন আর পড়ার চাপে সপ্তাহের পাঁচ দিন থাকতে হত তটস্থ ও বিদ্যা-সিদ্ধ(অতিরিক্ত পড়ার চাপে সিদ্ধ) হয়ে গৎ বাধা দিন ও রাত,থাকতাম আরামবাগের মেসে ,ভোগান্তি আর অশান্তির শেষ ছিল না ।বৃহস্পতি বারে তাই আমাদের বৃহস্পতি থাকত তুঙ্গে, কারন শুক্র ও শনি দুদিন বন্ধ , বৃহস্পতি বার দিন বিকেলে চলে যেতাম সাভারে নানা নানীর কাছে আবার কোন বৃহস্পতিবার যেতাম টাংগাইলে গ্রামের বাড়ীতে ,সাথে থাকত বন্ধু সুপ্রিয় তৌফিক মাম্মা ,মামার সব কিছুই পোক্ত বয়সের তুলনায় একটু বেশি মাত্রায় আগে।

মামা তখন বিশাল প্রেমিক আর নায়িকা থাকেন ভারতেশ্বরী হোমস এ,বিশেষ কারণে নায়িকার নাম লিখতে পারছি না ,ধরি তার নাম নদী , তো নদীর সাথে মামার দেখা করতে হবে কিন্তু কেমনে ভারতেশ্বরী হোমস তো খুব কড়া ঝাঁঝাল শাসন আর নিয়ম কানুন , যেহেতু ভারতেশ্বরী হোমস আমার গ্রামের বাড়ির কাছেই তাই এমনি এক বিকেলে আমরা দুজন বের হলাম টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে, পরের দিন নায়ক নায়িকার দেখা হবে বহুদিন পর , বাড়িতে পৌঁছে রাতেই দুজনে প্লান করলাম কাল কিভাবে কি করব ? যেভাবেই হোক মিশন পসিবল করতে হবেই হবে , ভিতরে যাবে এমন কোন গার্ডিয়ান কে পটাতে হবে যাতে করে আমাদের কে তার সাথে করে ভিতরে নিয়ে যান , যে কথা সেই কাজ।

পরের দিন সকালে বেড়িয়ে পড়লাম দুজনে হোমসের উদ্দেশ্যে, গেটে পৌঁছেই দেখি অনেকেই দাঁড়িয়ে আছেন ভিতরে ঢুকবে বলে , তাদের আশেপাশে যেতেই যেভাবে তারা তাকাচ্ছেন তাতে তাদেরকে ম্যানেজ তো দুরের কথা কোন কথা বলারই সুযোগ নেই, এরই মাঝে দেখি মামা এক আপার সাথে কথা বলছেন- আপা আমার ছোট বোন এখানে পড়ে , আমরা দিনাজপুর যাচ্ছিলাম কিন্তু মির্জাপুরে এসে আমাদের গাড়ির ইঞ্জিনে সমস্যা অনেক সময় লাগবে তাই এখানে এলাম কিন্তু বোনের সাথে দেখা করার কোন উপায় নাই, আপনি যদি আপনার ভাই বলে আমাদের দুজন কে নিয়ে যেতেন তাহলে খুব উপকার হত , বরফ গলতে শুরু করেছে , আপা বলছেন ঠিক আছে কর্তৃপক্ষ এলাও করলে আমার সমস্যা নাই ।

যথারীতি উনার সাথে যাওয়া শুরু করলাম, যেই গেটে পাস চেক করা হচ্ছে সেখানে এসে আপার পাস দেখে ভিতরে যেতে বললেন ,আমরাও ঢুকার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় বললেন যে আপনার সাথে আর কেউ যেতে পারবেন না । অভাগা যেদিকে চায় সাগর নয় হিমালয় পর্বত ও শুকিয়ে যায়! সেই অচেনা আপা ঢুকার সময় বলে গেলেন যে আপনারা হাসপাতালের ভিতরে যান ওখান থেকে দেখা যায় এবং টুকটাক কথাও বলা যায়, হাসপাতাল মানে কুমুদিনী হাসপাতাল । যে কথা সেই কাজ ,হাসপাতালের ভিতরে গিয়ে খুঁজে খুঁজে বের করলাম যে কোন পাশ থেকে ভালভাবে দেখা যায় কথা বলা যায় , কিছুক্ষণ পর পেলাম, ওখানে গিয়ে দেখি মেয়েদের আলাদা আলাদা রুমের জানালা খোলা ,কেউ কেউ বসে আছেন, মেয়েরা আমাদের দেখছে মাত্র দুজন ছেলে আর অসংখ্য মেয়ে ,উড়াল চুম্বন ছুড়ছে ,মুখ ভেচকি মারছে ! মনে হচ্ছে আমরা দুজন মেয়ে আর ওরা ছেলে

মামা এরমধ্যেও বার বার চিৎকার করে বলছে নদী কে ডেকে দিবেন ? খুব জোরে বললে একটু শোনা যায় এমন, এভাবে অনেক ক্ষণ চিৎকার চেঁচামেচি করেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না এমন সময় দেখি একটা ছেলে পিছন থেকে আমাদের ফলো করছে , তার দিকে তাকাতেই সে বলল আপনারা এখানে না থেকে পিছন দিকে নদীর ধারে যান ওখানে কথা বললে শুনা যাবে , এই জায়গার চাইতে ওখানে বেশি কাছাকাছি, ব্যর্থ মনোরথে দুজনে হোমসের পিছনের দিকে নদীর পাশে চলে এলাম ।

বিধিবাম !কিসের কী! এটাও অনেক দূর যেখান থেকে কথা বললে কিছুই শুনা সম্ভব না , দুজনেই খুব দুশ্চিন্তা মগ্ন হয়ে পড়লাম ,আমরা দুজন একসাথে বিন্তু কোন কিছুতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছি এমন ঘটনা বিরল ।এরমাঝে খেয়াল করি যে হোমসের যে গেট টি নদীর ধারে সেটি খোলা ,বেশ কিছু চীনা পর্যটক এসেছেন এখানে ঘুরে ঘুরে দেখছেন ,তারা ঐ গেট দিয়ে বের হয়ে নদীতে রাখা ইঞ্জিন চালিত নৌকাতে উঠছেন কিন্তু গেট টি খোলা । সবাই বের হয়েছেন গেট এ গার্ড বা অন্য কেও নাই , এই সুযোগ মনে হয় আল্লাহ আমাদের করে দিলেন, আমরাও এর সদ্ব্যবহার করে ফেললাম,মুহূর্তের মধ্যেই ভিতরে ঢুকলাম, সোজা হোমসের একেবারে ভিতরের গেটে , এ যেন সাত সমুদ্দুর তের নদী পার হয়ে নায়ক এলো নায়িকার কাছে !

মামা তো গেটে এসেই একটা মেয়েকে বলেছে নদীকে ডেকে আনার জন্যে , কিছুক্ষণের মধ্যে নদী হাজির , একে বারেই মুখোমুখি হাতে হাত রেখে এভাবে দেখা হবে এটা নদী চিন্তাই করে নি ,সে বলল তোমরা এই খানে কেমনে আসলা ?
মামা খুব বাহাদুরির ভঙ্গী তে বলছে তোমার জন্যে এটা তো খুব ছোট একটা কাজ ,তুমি চাইলে আমি পৃথিবী টাকে হাতের মুঠোয় এনে তোমার হাতে এনে দিতে পারি ! আমি কাবাবের হাড্ডি না হয়ে পাশেই ঘুরাঘুরি করতে লাগলাম, এর মধ্যে নির্ধারিত সময় প্রায় শেষ, অনেকেই বের হচ্ছেন, নায়ক নায়িকার হাতে হাত রেখে আলতো ছোয়ায় শান্ত হয়ে বিদায় নিলেন, বিচ্ছেদে বাড়ে প্রেম বিদায়ে সে কাঁদেন

আমরা যে গেট দিয়ে ঢুকেছিলাম সেখানে গিয়ে দেখি গেট তালাবন্ধ ,তাহলে উপায় ? উপায় একটাই সবাই পাস দিয়ে যে গেট দিয়ে ঢুকেছে সেদিক দিয়ে বের হওয়া , ঐ গেটে যেতেই দেখি আবার পাস চেক করে করে বের করছেন ,আমাদের তো পাস নাই তার মধ্যে একবার সেই আগুন্তুক আপার সাথে গেটের লোকজন দেখেছে যে এরা ঢুকতে এসেছিল , আমাদের কে দেখেই বলে কি ব্যাপার আপনারা কিভাবে ভিতরে গেলেন ,আপনাদের পাস কই ? পাস দেখাতে পারছিনা ,তাহলে তোরা ভিতরে ঢুকছিলি চুরি করে চুরি করতে না হয় কোন মেয়ের রুমে ঢুকছিলি আকাম করতে ! মুহূর্তের মধ্যে সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা এই ভদ্র লোকের কথার ধরন পালটে গেল, আপনে থেকে তুই , চোর ! আমাদের দুজন কে তাদের গার্ড রুমে আটকিয়ে রাখা হল, তিনি বলছেন থানায় ফোন কর ,এই শয়তান দুই টারে আজকে চালান করার ব্যবস্থা করতেছি

জানালা দিয়ে আমরা আকুতি মিনতি করছি, ভাই প্লিজ আমরা চোর বাটপার বা কোন খারাপ উদ্দেশ্যে যাই নাই, আমরা পড়াশুনা করি , আমরা বখাটে ফালতু ছেলে না , তোরা কিসে পড়িস কোথায় পড়িস ? বললাম আমরা দুজনেই নটর ডেম কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি , কি নটর ডেম কলেজে পড়
সত্যি সত্যি ! কার্ড আছে সাথে ? বললাম জ্বি আছে বলেই দুজনেই কলেজের আইডেন্টিটি কার্ড দিলাম , উনি অনেক ক্ষণ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে দেখলেন, সাথে সাথেই বললেন এই এদের বের কর , আর থানায় ফোন করে বল কারো আসা লাগবে না , তোমরা বাংলাদেশের সবচেয়ে ভাল কলেজের ছাত্র হয়ে আজকে এটা কি কাজ করলে , জানো আমার খুব ইচ্ছা ছিল আমার ছেলেটাকে নটর ডেম কলেজে পড়াব, এত কোচিং ফোচিং করেও সে চান্স পায় নাই আর তোমরা সেই কলেজের ছাত্র, তোমাদের কে কি আমি আটকিয়ে রাখতে পারি ! যাও যাও যাও সোজা যার যার বাড়িতে যাও আর জীবনেও এমন কাজ করবে না ।

মনে মনে বলতে লাগলাম জয়তু নোটা ডাম যার অর্থ আমাদের মা, জয়তু মা ! তোমার কল্যাণে তোমার পুত্র সকল প্রেমিক সাজিয়া একশ এক টি নীল পদ্ম আনিয়া এবং সাত সমুদ্দুর তের নদী পার হইয়া বিপদ গ্রস্থ হইয়া এ যাত্রায় বাঁচিয়া গেল ।স্যালুট নটর ডেম কলেজ ,স্যালুট মামার ভালবাসা!


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন