(
১)
আমার
মমতাময়ী ও জান্নাতবাসী মা রওশন আরা, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পরে ও মায়ের
হাতে একদিন চড় খেয়েছিলাম ,
মাকে ভীষণ ভয় পেতাম । সন্ধ্যার ঠিক আগে
আগে বাসায় না ফিরলে মা আমাদের দুই ভাইকে খুঁজতে বের হতেন , যদি কোন কারণে না পেতেন তবে বাসার
সামনে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন । এমনি ভীত সন্ত্রস্ত থাকতাম আমরা সারাক্ষণ ।
বিকেলে মাঠে খেলতাম আর সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরে হাত মুখ খুব ভালভাবে ধুয়ে পড়তে
বসতাম , মা কিছুক্ষণ পরে এসে হাত পা চেক করতেন
কোন ময়লা আছে কিনা ? ময়লা থাকলেই চড় , এভাবেই তটস্থ ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে হয়ে
স্কুলের ছাত্রজীবন টি কেটেছে , এই
মায়ের কল্যাণে আমি অষ্টম শ্রেণীতে বৃত্তি পাই, এসএসসি তে মানবিক বিভাগ থেকে রেকর্ড মার্ক নিয়ে স্টার মার্কস পেয়েছি এবং এরপরে দেশের
সবচাইতে স্বনামধন্য শীর্ষ কলেজ নটরডেম কলেজে ভর্তি হই ।
আমার মা ভীষণ
রূপবতী গুণবতী ছিলেন , রূপে
রসে রন্ধনে বন্ধনে ছিলেন অপরূপ অসাধারণ । রাগী হলেও তার মন টি ছিল খুব উদার এবং
নরম ।আমাদের মা এর জন্য আজকে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছি অথচ আমি-বুক ফুলিয়ে গর্বের সাথে বলতে পারি যে আমার মা শুধু নিজের
নামটি লিখতে পারতেন লেখাপড়া বা ট্র্যাডিশনাল একাডেমিক শিক্ষা তার না থাকলেও তার
একনিষ্ঠ পারিবারিক শিক্ষা আমার জীবনের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ।
পান
খেতেন আর ফর্সা মুখখানি লাল হত ঠোট লাল জিহ্বা লাল , মায়ের মুখের সেই চাবিয়ে খাওয়া পান আমি নিয়ে খেতাম কিযে অমৃত-সুধা সেই
পান, পৃথিবীতে আর কোন দিন সেই আধো চাবানো
স্বাদের পান খাওয়া হয় নাই। মায়ের সুন্দর ফর্সা মুখে পানের টুইটুম্বর রস আর আলতো
জর্দার ঘ্রাণ আমাকে ভীষণ আপ্লুত করত , সারা ঘর জুড়ে সেই ঘ্রাণ মৌ মৌ করত আর সুবাস ছড়াত , ভাবতাম এটার নাম বিধাতা বোধ হয় দিয়েছেন
সুখের ঘর , সুখের বাধন ,সুখের নীড় । আমার মা উলের সোয়েটার
বুনতেন , শীতের আগে আগে , বহুদিন ধরে বুনে বুনে আমার জন্য একটা
হাফ সোয়েটার বুনে দিতেন ,
সেই উলের ঘ্রাণ আর আস্তে আস্তে একটু
একটু করে যেভাবে পুরোটা বুনতেন ঠিক একই রকম ভাবে আমার সারাটি জীবন আস্তে আস্তে
ধীরে ধীরে একটু একটু করে বুনে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মানবিক বোধসম্পন্ন প্রতিষ্ঠিত জীবনের মুল কাঠামো বুনে বুনে
বুনিয়াদী করে দিয়েছেন, সেই বুনিয়াদী কাঠামোর জন্যই সমাজে আজকে
শির উঁচু আসন এবং আজকের পুলিশ সুপার হয়ে উঠা । মায়ের কাছে এত এত ঋণের অল্প সবেমাত্র শুরু , মা বিহীন প্রতিটি দিনই চোখের কোনে
অশ্রু আর বুকের মাঝ খানে কেঁপে উঠা ।
(২)
আমার
বাবা সুগার মিলে চাকুরী করতেন সেই সুবাদে আমরা থাকতাম কলোনিতে । উত্তরের সর্বশেষ
প্রান্তের সীমান্তের সেই ছোট শান্ত একটি ভূখণ্ডের জেলা ঠাকুরগাঁও , এখানেই আমাদের মা বাবা ভাই বোন স্কুল
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় এর সময়গুলো পর্যন্ত এখানে কেটেছে । ধন সম্পদ প্রাচুর্যের মধ্যে
বড় না হলেও পারিবারিক যে শান্তি আর সুখবোধ ছিল তা আমাদের প্রকৃত মানুষ করে গড়ে
তুলতে অনেক সহায়ক হয়েছে।আমার বাবা আর মায়ের সম্পর্ক টা কখনো খুব উষ্ণ আবার কখন খুব
শীতল ছিল।
মাঝে
মাঝে সিরিয়াস টাইপের ঝগড়াঝাঁটি করতে দেখতাম আর মা হু হু করে শব্দ করে কাঁদত, বালক চোখে শুধু মায়ের কষ্টের তীব্রতা
অনুভব করতে চেষ্টা করতাম ,
আমি আর আমার বড় ভাই খুব মনমরা হয়ে
থাকতাম । মনে হত মা এভাবে কাঁদছেন ! বাবা কে মেরে ফেলি ! আশির দশকে এমন ধরনের একটি
ইস্যুতে আমার মা কান্নাকাটি করে করে আমাকে
আর আমার ভাই টিটু যে আমার চেয়ে দেড় বছরের বড় ছিল , আমাদের দুজনকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন , সাভারে আমার নানা-বুজি নানা মামা
খালারা থাকতেন । আমরা ক্লাস টু কি থ্রিতে পড়ি , বিআরটিসি বাসে করে ঠাকুরগাঁও থেকে রওনা , প্রায় ৫০০ কিঃমিঃ পথ পাড়ি দিতে হবে ৩
ঘণ্টার ফেরী পারাপার সহ ১২ ঘণ্টার পথ ।
আমার শুধু মনে আছে মা আমাদের দুই ভাই কে মুরগির
বাচ্চার মত ওম দিয়ে সারা রাস্তায় গাড়িতে আমাদের আগলে ধরে বসেছিলেন , নগরবাড়ি ঘাটের কথা আমার এখন ও অল্প মনে
আছে । নদীর পাড়ে সেই যে টিনের ঘরের মাঝে খাবারের হোটেল ডাকাডাকি ডিম ঝালমুড়ি এসবের
ডাক , এরপরে ফেরীতে উঠা আর মাকে নানা প্রশ্ন
করা । মনে মনে উৎফুল্ল আমরা দুই ভাই কারণ নানার বাড়ি মানেই মজার খনি, সাভারের রাজালাখ উদ্যানে ঘুরে বেড়ান, পুকুরে ঝাঁপিয়ে গোছল, গাছে গাছে টিলোস্প্রেস খেলা নানান রঙের
সেই দিনগুলি ।
বাবা মা এর ঝগড়ার সুবাদে সে যাত্রায় আমরা ৩ মাস
সাভারে থাকলাম, এরপরে আমার মামা চাচারা একসাথে বসে
আমার মাকে বোঝান হয় যে – তোমার এই দুই ছেলে সবচেয়ে বড় সম্পদ
তোমার , ওদের দিকে তাকিয়ে ওদের ভবিষ্যতের কথা
ভেবেই তোমার যাওয়া উচিত । এতে কাজ হল, কয়েকদিন পরেই আব্বা সাভারে এসে আমাদের
ঠাকুরগাঁও নিয়ে গেলেন ।
৩)
১৯৭৬
সালের আমাদের মা এর বিয়ে হয়, প্রথম ঘরের সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর এটা আমাদের বাবার
দ্বিতীয় বিয়ে । সে ঘরে আমাদের সবার বড় বোন (বৈমাত্রেয়) মাকরুমা । যে কারনে শুরুর
দিকে আমার মা ও বাবার সম্পর্কটা এতটা মধুর ছিল না । ১৯৭৭ সালে জন্ম নেয় আমার বড়
ভাই দেওয়ান সিরাজুল ইসলাম টিটু । এরপরে ১৯৭৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার দিবাগত
রাত ১’৫২ মিনিটে এই পৃথিবীর আলো দেখি আমি । মায়ের বর্ণণা মতে- দেখতে নাদুস নুদুস
চাঁদের মত আদুরে মুখ নিয়ে আমার জন্ম । আমার কপালে একটি গোল চক্র আছে , গনকরা আমাকে
দেখে নাকি বলত –আপনার এই ছেলে রাজতিলক নিয়ে জন্ম গ্রহন করেছে এবং এই ছেলে দেশের
রাজা হবে! ছোট থেকেই আমি ছিলাম সবার মধ্যমণি । যেহেতু এখন আমাদের ভাই বোনের সংখ্যা
৩ তাই আমি এদের মধ্যে সবার ছোট তাই আদর টার পুরোটায় আমার দিকে , স্বাস্থ্যবান ও
নাদুস নুদুস প্রকৃতির জন্য ছোটবেলায় আমাকে যে দেখত সেই কোলে নিত , যার ফলে কপালে
সদা একটি বড়মাপের কাজলের টিপ আঁকা থাকত প্রটেকশন হিসেবে যাতে কারোর নজর না লাগে
আমার উপর ।
এভাবেই
হেঁসে খেলে একেবারেই শৈশবের সময় গুলো যা মা বাবার কাছে শোনা । ১৯৮৩ সালে স্কুলে
ভর্তি করা হয় আমাকে একা নয়, আমাদের ৩ ভাইবোন কে একসাথে এক ক্লাসে , ৩ জনের একসাথে
পড়তে বসা , একসাথে প্রাইভেট পড়তে যাওয়া , স্কুলের পড়া তৈরি করা এসব । আমাদের বড়
বোন মাকরুমা ক্লাস ওয়ান থেকে ফোর পর্যন্ত ক্লাসের ফার্স্ট, প্রতিবছর সে পুরস্কার
পেত আমাদের সেই সুগার মিলের জিএম এর কাছ থেকে পুরস্কার নিত । ১৯৮৭ সালের ২রা সেপ্টেম্বর
আমাদের মায়ের কোল জুড়ে এল ছোট বোন- ছলেমন নেছা নিপু, তখন আমরা ক্লাস ফোরে পড়ি । নিপুর নাম আমরা রাখলাম- উন্মুল সোনিয়া হক নীরা
কিন্তু আব্বা খুব এডামেন্ট মেয়ের নাম রাখবেন আমাদের দাদীর নামে , তাই হল, হুবহু আমাদের
দাদীর নাম- ছলেমন নেছা রাখা হল এবং ডাক নাম –নিপু ।
(চলবে)