বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৭

সস্তারাম বস্তাবান দড়ি ধরে মার টান



ছেলেবেলার ঈদ মানেই ছিল রোজার ঈদ কারন এ ঈদে পাওয়া যেত নতুন জামা স্যান্ডেল জুতা আরো কত কি, তবে কোরবানীর ঈদের শান শওকাত ছিল আবার আরেক ধরনের, আমরা থাকতাম কলোনীতে, কোরবানীর ঈদ মানেই ছিল গরু গরু তে প্রতিযোগিতা, কাদের গরু কত বেশী সুন্দর আর হৃস্টপুস্ট ,নাদুস নুদুসগলায় লাল ঝালটের মালা জরিয়ে মাঠের মাঝে সবাই সবার গরু গুলি বের করত । নদীতে নিয়ে গিয়ে গরু কে গোসল করাতাম সুগন্ধি বাসনা সাবান দিয়ে, কলোনীর সবাই কয়েকজন মিলে মিলে একটা গরু কিনত। সেবার ও ব্যতিক্রম হল না ।


পাশের বাসার রহমান কাকা, মজনু কাকা, ইব্রাহিম কাকা ও আমরা ছিলাম । বরাবরই একসাথে গরু কিনে ভাগ করে কোরবানী দিতাম, আর এই সব কাকা দের ছেলে মেয়ে আমরা মিলে গরু টাকে আমাদের নতুন একজন হিসেবেই মনে করতাম, সেবার আমাদের রহমান কাকা যিনি একজন গরু ও গরুর হাট বিশেষজ্ঞ ! তার জন্মই যেন শুধু গরু কেনা ও কিনে দামে বিস্তর জেতা এবং সবার গরু গুলির দিকে কেলিয়ে কেলিয়ে নিজের গরুটার দিকে তাকিয়ে হাত বুলিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর গেলান ।

 ১৯৯৩ সালের কথা, সামনে কোরবানীর ঈদ, গরু কেনার ধুম পড়েছে।সবাই গরু কিনে ফেলছে কিন্তু আমাদের গরু কেনা হচ্ছে না, আমরা ভাই বোনেরা সহ অন্যান্য কাকাদের ছেলে মেয়েরাও খুব খুব উদবিগ্ন, পাশের বাড়ির মামুন রা আমাদের দেখিয়ে দেখিয়ে গরু নিয়ে কিলকিলিয়ে ঘুরছে, ছোট ভাই রাহাত রীতিমত কান্না কাটি শুরু করে দিছে , ঈদের আর মাত্র ৬ দিন বাকী, অথচ গরু নাই ?

কারন জানা গেল এটা আমাদের রহমান কাকার তেলেসমাতি , তিনি কম দামে রয়ে সয়ে ভাল তরতাজা গরু কিনবেন, কিন্তু আমাদের তো আর সয় না, মাঠে খেলতে গেলে বা রাস্তায় দেখা হলে রফিক রুস্তম রা ব্যংগ করা শুরু করল - কিরে তোরা বলে এবার হাতি না ঘোড়া কোরবানী দিবি ! এরকম নানা জাতের ভর্ত্তসনা শুনতে লাগলাম এবং আমাদের দেখলে জোরে জোরে সাউন্ড দিয়ে কোরবানী কোরবানী আল্লাহ কী মেহেরবানী কোরবানী এই গান শুনাতে লাগল, অবশেষে দুই দিন পর গরু এল, শীতের রাত গরু দেখে আমাদের সে কী খুশি যা ভাষায় প্রকাশ করা যাচ্ছে না ।

গলায় ঝালটের মালা আর পশ্চাদদেশে ছালার বস্তার জ্যাকেট, মনে মনে ছড়া কাটলাম-
‘’হাম্বা হাম্বা নাদুস ভাই
শীত পড়েছে উপায় নাই !
সস্তারাম বস্তা বান
দড়ি ধরে মার টান ‘’

রহমান কাকা খুব বুক টান দিয়ে দিয়ে হাটছেন আর বলছেন ৫৬৭০ টাকা, এই গরু কি কেউ পাইবো ? রাতে গরু টি চলে গেল যথারীতি রহমান কাকার গোয়াল ঘরে, তার রয়েছে আরও ৮/১০ টি গরু, সকাল বেলায় আমরা ৩ ভাই বোন পড়ছি, হঠাৎ শুনি অনেক কথাবার্তা লোকজনের আনাগোনা, কি ব্যাপার!

হায় ! এতো দেখছি গাভী ? আমরা হা করে দেখতে লাগলাম , অন্যান্য কাকারা রহমান কাকার সাথে রীতিমত যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছেন,তিনি বুঝাতে চেস্টা করছেন যে বানজা গরু করবানী করা জায়েজ, আপাতত সবাই একটু ঠান্ডা হল।নিন্দুক দের ভয়ে আমরা ওদিন য়ার ঘর থেকে বের হলাম না, কিন্তু হায় বিকালে একি শুনলাম, ভেটেনারি সার্জন দুলাল ভাই এসে গাভী দেখছেন আর বলছেন যে এটা গর্ভবতী ! এটা দিয়ে করবানি হবে না , সবাই মিলে সেই রহমান কাকার তিন পুরুষ উদ্ধার করলেও তিনি নাছোরবান্দা, যেহেতু গাভী তাই এটা কে তিনি কিনে নিবেন, বাধ সাধলেন ইব্রাহিম কাকা, মনির কাকারা তারা সবাই এখন এই গাভীটার মালিক হতে চায়, কিন্তু! গরুর মশাই গরু বিশেষজ্ঞ রহমান, সস্তায় সস্তায় সব পান সব চান

 অবশেষে তিনি ধরলেন নতুন সুর , আমি দাম ৫৬৭০ বললেও এটার দাম আর ১০০০ টাকা বেশী, সকলের কাছে আমাদের গরু কে কম দামে ভাল দেখাতেই এই পন্থা। যদিও কেউ এটা বিশ্বাস করল না, কারন রহমান কাকা খুব বৈষয়িক ও স্বার্থপর প্রকৃতির লোক । তিনি কখনই এক টাকা বেশী দেবার লোক না , আমরা খুব আশাহত ও মর্মাহত হলাম। আব্বা ঈদের আগের দিন আমাদের জন্য একটা খাশী কিনে আনলেন,আমরা ওটা নিয়েই সন্তুস্ট থাকলাম

 ঈদের আগের দিন বিকালে হঠাৎ চিৎকার চেচামাচি আর হাউমাউ করে কান্নার শব্দ ! আর্তনাদ আর বুক ফাটা ক্রন্দন , রহমান কাকার বাসা থেকে এই শব্দ আসছে, আমরা সবাই এগিয়ে গেলাম, রহমান কাকা নিজেও কাদছেন, আর বুকে হাত দিয়ে বলছেন হায় রে আমার গাভিটা ! দুপুরে গোরস্থানে বাধা ছিল ঘাস খাবার জন্যে , ঘন্টা খানেক পরে গিয়ে দেখি যে গাভী নিজের দড়ি তে প্যাচ খেয়ে নিজের গলাতে ফাস লেগে আছে, মরে গেছে !
 হায় ! হায় ! হায় ! হায় -
ত্যাগের মর্মে মর্মান্তিক ব্যাথা্য ব্যাথিত হয়ে সস্তারামের দড়িতে টান মেরে এই হাম্বা হাম্বা নাদু প্রানীটি আমাদের কি শিখিয়ে দিয়ে গেল ?


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন