বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২০

উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে


চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড থানার রামপুর গ্রাম, এই গ্রামের অধিবাসীরা বেশির ভাগ থাকেন বিদেশে আর ঢাকায়। কালে ভদ্রে তারা গ্রামে আসেন। এই গ্রামে চৌধুরী বাড়ি আর খান বাড়ি নামে দুটি প্রসিদ্ধ পরিবার আছে। এই দুই পরিবারের মধ্যে যুগ যুগ ধরে বিরোধ। এই দুই পরিবার তাদের নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বজায় রাখতে দুই পক্ষ যার যার অধীনস্থ গুন্ডা ষণ্ডা পুষতে থাকেন। রুবেল নামের একজন মাস্তান ও অতিশয় খারাপ ব্যক্তি কয়েক বছর চৌধুরী পরিবারের আবার পরের কয়েক বছর খান পরিবারের হয়ে কাজ করেন ডিগবাজি দিতে ওস্তাদ এই ডিগবাজ মারুফ ইসলাম রুবেল। এই মাস্তান রুবেলের জীবন যাপন খুব অস্পষ্ট ও রহস্যে ভরা।

অধিকাংশ সময় তিনি গ্রামের বাইরে ঢাকায় থাকেন, দামী গাড়ি নিয়ে বাড়িতে আসেন । গ্রামে তার আত্মীয়  স্বজন কেউ থাকেনা। তার বাবা ইন্তাজ মিয়া শিপ ব্রেকিং শ্রমিক ছিল মারা গেছেন আরো ১৫ বছর আগে। মা সাফিয়া বানু তাঁর সাথে ঢাকার রামপুরা তে থাকত কিন্তু তিনিও বছর পাঁচেক আগে গত হয়েছেন। রুবেলের বয়স ৪৬, বিয়ে করেছেন ৩টা, সন্তান  আছে প্রথম দুই ঘরে দুইজন। তারা কেউ এই রামপুর গ্রামে থাকেন না। তবে মাঝে মাঝে রাত বিরাতে রুবেল তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ সহ গ্রামে আসেন তাঁর পৈত্রিক ভিটায় একজন কেয়ারটেকার থাকেন সেখানে এসে উঠেন ভুড়িভোজ সেরে আবার চলে যান। প্রায়শ তিনি গরু জবাই দিয়ে মা বাবার জন্য দোয়া পড়াবার জন্য মেজবান এর আয়োজন করেন। এলাকাবাসীর কাছে তিনি দানবীর ও বিত্তশালী হিসেবে বেশ পরিচিত। তার সাথে স্থানীয় থানার অফিসারদের সাথে খুব দহরম মহরম, থানার কোন অনুষ্ঠানে থাকলে রুবেল লাখ টাকার নিচে কোনদিন টাকা দিয়েছে এমনটা হয় নাই।

 (২)
 ২০০৬ সালের ৮ নভেম্বর, ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের গজারিয়াতে এক রাতে ছয়টি কাভার্ড ভ্যান মিসিং। সিগমা এপারেলস, অরুনিমা গ্রুপ এবং সাদমান গ্রুপের এই ছয়টি কাভার্ড ভ্যান শিপমেন্টের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে যাচ্ছিল। গভীর রাতে রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে অস্ত্র দেখিয়ে ড্রাইভারদের চোখ বেঁধে তাদেরকে গাছের সাথে বেঁধে রেখে এই ছয় কাভার্ড ভ্যানের মালামাল লুট করা হয়। সব মালামাল গুলোই গার্মেন্টস আইটেম। এই দুধর্ষ ডাকাতিতে উপর মহলে সাড়া পড়ে গেল। স্বরাস্ট্র মন্ত্রী, বিজিএমই, আইজিপি সবাই উদ্বিগ্ন এবং পুলিশ সুপার মুন্সিগঞ্জের উপর সব প্রেশার একসাথে আসতে লাগল। চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা এসপি শহীদুল্লাহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলেন।

পুলিশ সুপার এই ছয় জন ড্রাইভারের মোবাইল ফোনের গত ১০ দিনের সিডিআর(কল রেকর্ডস) আনতে বললেন এবং তাদের কে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যেতে বলেন। কল রেকর্ডস বিশ্লেষণ করে একদিন পরেই ঢাকার ডেমরা থেকে এই ঘটনার প্রধান হোতাকে গ্রেফতার করা হল, তার নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করার পর তিনি জানান – নাম- আসলাম হোসেন জনি, বয়স -৪৬, পিতা – মরহুম বেলায়েত হোসেন, মাতা- মরহুম হনুফা বেগম, গ্রাম- রামপুর, থানা- সীতাকুন্ড, জেলা – চট্টগ্রাম। পেশা- রোড ডাকাতি করা, প্রতি তিন মাস পর পর তার নিয়ন্ত্রিত বাহিনী এমন একটি করে ঘটনা ঘটায় আর লুটকৃত  মালামাল আরেকটি সিন্ডিকেটের দ্বারা কিছু লোকাল মার্কেট আর কিছু দুবাই এর মার্কেটে পাঠান। এভাবেই তার সংঘবদ্ধ ডাকাতির গ্যাং এবং লুট করা মালামালের সিন্ডিকেট নিয়ে বছরের পর বছর এই ডাকাতি ব্যবসা(!)করে জনি এখন কোটি কোটি টাকার মালিক।

 (৩)
 চৌকস পুলিশ কর্মকর্তা শহীদুল্লাহ সব কিছু শুনে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে এই কুখ্যাত ডাকাতের সব কথা সত্য নাও হতে পারে, যে এই ধরনের দুধর্ষ ঘটনা ঘটাতে পারে তার কোন তথ্য যাচাই বাছাই ছাড়া নেয়া যাবে না। এজন্য তিনি মামলার আইও কে নির্দেশ দিলেন যে এই ডাকাত জনির একটা ছবি তুলে ই/এস(ইনকোয়ারী স্লিপ) এর সাথে সেই ছবি দিয়ে সীতাকুন্ড থানাতে পাঠাতে।  নাম- আসলাম হোসেন জনি, বয়স -৪৬, পিতা – মরহুম বেলায়েত হোসেন, মাতা-মরহুম হনুফা বেগম, গ্রাম- রামপুর, থানা- সীতাকুন্ড, জেলা– চট্টগ্রাম। পেশা-  ডাকাতি করা, এর পিসিপিআর (প্রিভিয়াস কনভিকশন ও প্রিভিয়াস রেকর্ড) যাচাই অনুসন্ধান করত দ্রুত প্রেরন করার জন্য ইএস প্রেরণ করা হল। এক সপ্তাহ পরে জবাব আসে – উল্লেখিত নাম ও ঠিকানা সঠিক, ঊল্লেখিত ব্যক্তির নামে ডাকাতি ও খুন সহ মোট ৪টি মামলার ওয়ারেন্ট রয়েছে তিনি দীর্ঘকাল ধরে পলাতক। তবে ছবিতে উল্লেখিত ব্যক্তির নাম ঠিকানা এটা নয়। ব্যতিক্রমী ভাবনার মানুষ পুলিশ সুপার শহীদুল্লাহ খুব আশ্চর্য হলেন যে ছবির ব্যক্তি সেই ব্যক্তি না, এর মধ্যে রিমান্ডে আনা হল সেই হোতা ব্যক্তি কে, রিমান্ডে তিনি খুব খুব লোমহর্ষক ও শিউরে ওঠার মতো তথ্য দেন।

 (৪)
 তার নাম - মারুফ ইসলাম রুবেল পিতা- মরহুম ইন্তাজ মিয়া মাতা-মরহুম  সাফিয়া খাতুন গ্রাম- রামপুর , থানা – সীতাকুন্ড জেলা – চট্টগ্রাম । সে এই পর্যন্ত যতবার ধরা পড়েছে সব যায়গায় সে নাম বলে- - আসলাম হোসেন জনি, বয়স-৪৬ , পিতা– মরহুম বেলায়েত হোসেন, মাতা-মরহুম হনুফা বেগম, গ্রাম- রামপুর, থানা-সীতাকুন্ড, জেলা– চট্টগ্রাম। এই নামে তাদের প্রতিবেশি একজন সত্যি আছেন যারা ঢাকায় থাকেন এবং কোন দিন জনি নামের ব্যক্তিটি জানেও না যে তার নামে ৪টি ওয়ারেন্ট পেন্ডিং আছে। এরপর সেই কুখ্যাত ও দুধর্ষ ডাকাত সর্দার রুবেল সব কিছু উল্লেখ অরে কার্যবিধি ১৬৪ ধারা অনুযায়ী স্বীকারোক্তি মূলক জবানবন্দী দেন। তার দেওয়া তথ্য লুন্ঠিত মালামালের ৮০ ভাগ উদ্ধার হয়।

 পুলিশ সুপার এরপরে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে একটি চিঠি লিখেন – ‘’ই/এস এর সাথে চাহিত ব্যক্তির ছবি অবশ্যই সংযোজন করতে হবে, তাহলে আর কোনো ব্যক্তি এমনভাবে উদোড় পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে দিতে পারবেন না এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য এটি সহায়ক হবে।