বৃহস্পতিবার, ২৬ জানুয়ারী, ২০১৭

হারাধনের সবেধন নীলমণি ও লোভাতুর আগন্তুক


লোকমান হাওলাদার মহাখালী বাস টার্মিনালে এসে পৌঁছালেন, তিন ঘণ্টার বেশি সময় লাগলমির্জাপুরের ছাওয়ালি মহেরা তার বাড়ি গত ছয় মাস ধরে ঢাকা আসা যাওয়া করছেন মালয়েশিয়া যাবার জন্যে, কখন পাসপোর্ট করার জন্যে আবার কখন মেডিকেল কখন এজেন্সি অফিসে টাকা জমা দেওয়া , কিন্তু কাজ আর শেষ হয় না ! মগবাজারের ওয়ারলেস গেটে ইউনাইটেড ট্রাভেল এর সফি মাদবর তাদের এলাকার জামাই, অনেক লোক নিয়েছে এলাকার তবুও কোন গ্যারান্টি নাই,গত বছর ত্রিশ জনের মত ফিরত আসছে, এরপরেও সফি মাদবরের কদর বিন্দু মাত্র কমে নাই লোকমান আজ এসেছে ভিসার কপি বের করতে , এজন্যে তাকে দিতে হবে ৩০ হাজার টাকা অনেক কাঠখড় পোড়ান এই টাকা জমি বন্ধক সুদী করে আনা টাকা বউ এর গয়না বেচা টাকা এগুলো , বিএ ফেল করে কিছু দিন একটা স্কুলে মাস্টারি করেছে, কিছু দিন এন জি তে চাকুরী করেছে কিন্তু ভাগ্যের চাকা আর ঘোরে না , তাই সব কিছু ঝেরে ঝুরে সর্বস্ব দিয়ে এই বিদেশ বিভূঁই যাবার বিরাট স্বপ্ন

নাটিয়াপারা থেকে বিরতিহীন বাস ঝটিকা তে করে সে ঢাকা এসেছে, সকাল ১১ টা , মহাখালী তে খুব জ্যাম লোকমান ভাবে এত টাকা নিয়ে টাউন সার্ভিসে উঠা ঠিক হবে না তাহলে সিএনজি অথবা রিক্সা , সিএনজি পাওয়া যাচ্ছে না, যদিও থামছে কিন্তু মগবাজারের কথা শুনে কেউ যেতে চাইছে না অগত্যা কি আর করা লোকমান ৩৫ টাকা ভাড়ায় একটা রিক্সা ঠিক করল মগবাজার পর্যন্ত রিক্সা টার্মিনাল থেকে চলতে শুরু করল, শুটিং ক্লাবের দিকে যাবার রাস্তার আগে ট্রাফিক সিগনালে পড়ল, আবার চলতে শুরু করল নাবিস্কোর একটু আগে ফাকা রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে রিকশাওয়ালা হঠাৎ রিক্সা থামাল, লোকমান দেখতে পেল রিক্সার সামনে একটা বড় পুটলি পড়ে আছে, রিক্সা ওয়ালা পুটলি টি উঠাল, সাথে সাথে ভিতরে একটা চিঠি আর তিন টি ছোট বক্স দেখতে পেল

রিকশাওয়ালা বক্স গুলি খুলে ফেলল , লোকমান সব কিছু মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখছে বলল - কি ভাই এগুলো, বোমা টোমা না তো ?রিকশা ওয়ালা তখন চিঠি টি দেয় লোকমানের হাতে, সে চিঠি টি হাতে নিয়ে পড়তে থাকে, চিঠিতে যা লিখা তা নিম্নরূপ-

বাবা সুরেন্দ্র
পত্র মাধ্যমে আমার স্নেহাশিস আশীর্বাদ নিও শুনে খুশি হইবে যে আমার দ্বিতীয় কন্যা শ্রীমতি গীতা রানী সাহার বিবাহ ঠিক হইয়াছে, কিন্তু তুমি আমার সার্বিক অবস্থা তো জানই, তোমার কাকীমা প্যারালাইজড হয়ে শয্যাশায়ী, তাহার পিছনে অনেক অনেক ব্যয় হইয়াছে, আমি এখন সর্বস্বান্ত হইয়া পড়িয়াছি, এমতাবস্থায় তোমার শরণাপন্ন হইলাম, পুত্র নিখিল সাহা কে তোমার নিকট পাঠাইলাম , সাথে ভরি ১২ আনা গহনা, তোমার কাকীমার বিয়ের সময় প্রাপ্ত হইয়াছিল এগুলো, একেবারে পাকা সোনা গহনা গুলি তোমার জুয়েলার্সে রাখিয়া যথাযথ দাম বুঝিয়া দিও দাম দর করার কিছু নাই ,তুমি আমার ঘরেরই সন্তান, তুমি আমাকে ঠকাবেনা আমি জানি অতি শীঘ্রই গহনা গুলি রাখিয়া টাকা পাঠিয়ে দিও , ভগবান তোমার মঙ্গল করুন
ইতি
তোমার জ্যাঠা
শ্রীমান হারাধন সাহা
কয়কীত্তন, ভবেরপারা
নিতাইগঞ্জ

লোকমানের চোখগুলি বড় বড় হতে থাকে, সে গহনা গুলি ভাল করে নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকে, ঠিকই তো
এগুলো তো সোনা, ভরির বেশী হবে, তাদের গ্রামে অনেক কর্মকারই তার বন্ধু, সময় পেলেই অই সব দোকানে সে আড্ডা মারত, সে রিকশাওয়ালার দিকে তাকায়, রিকশাওয়ালা তার দিকে তাকায় বলে স্যার এগুলা আফনে নিয়া যান, আমারে এগুলা সহ কেউ দেখলে পুলিশে দিব, দেইহা মন ডা কইতাছে আল্লায় আফনেরে গুপ্তধন দিছে ভাগ্য ফিরানের লাই স্যার আমারে অর্ধেক দাম দিয়া আফনে নিয়া যাইন গা,দেহি বলে সে লোকমানের হাত থেকে গহনা গুলি নেয়, হাতে নিয়ে সে আনুমানিক ওজন দিতে থাকে, স্যার / ভরি হইত, আমারে ত্রিশ হাজার টেকা দেইন, সাথে না থাকলে মুবাইল করেন 

লোকমান ভাবে সাধু বাড়ির কথা, সাধু একদিন তাকে বলেছিল
-ধ্যানং যোগং ফলং ফলা ,
প্রভুং সর্বস্বং দাতা প্রিয়নং 
অর্থাৎ ধ্যান যোগীতে ফল আসে প্রভু তাকে প্রিয় বলে দান করেন
সে ভাবে ঠিক ঠিক প্রভু আজ তাকে দান করলেন।

ভরি সোনার দাম লক্ষাধিক টাকা ! সে কাল বিলম্ব না করে পঁচিশ হাজার টাকা রিকশাওয়ালাকে দিয়ে বলল- ঘুরাও, রিক্সা ঘুরিয়ে সে আবার টার্মিনালের দিকে যেতে লাগল, সোজা ঝটিকা পরিবহন, সোজা ছাওয়ালি মহেরা বাজার বিকাল টায় সে বাজারে গিয়ে পৌঁছল, সুনীল কর্মকারের দোকানে, সুনীল বলছে কি রে ? লোকমান এত খুশি কিয়ের নিগা, আগে আমার এই সোনা গুনি মাপ আর কষ্টি পাথর আনো সুনীল তাই করতে শুরু করল, মুহূর্তেই লোকমানের উৎফুল্ল বাহারি চেহারা ফিকে হয়ে গেল, সুনীলের কথা তে, বলছে- এই গুলা সোনা নয়, পিতল লোকমান ঠাস করে পরে গেল, সবাই ধরাধরি করে মাথায় পানি ঢালতে থাকল,

লোকমান প্রতারিত হয়েছে, যে রিক্সায় সে উঠেছিল তার সামনে আরেক টি রিক্সা ছিল , সেই রিক্সা কে লোকমানের রিক্সা অনুসরণ করছিল, অই রিক্সা থেকেই পুটলি টি ফলান হয়েছিল লোকমানের মত অভাবী সরল লোকেরাই এদের শিকার আমাদের দেশে রয়েছে এই রিকশাওয়ালার মত এক শ্রেণী যারা ধূর্ত কূটকৌশলী প্রতারক এবং রয়েছে লোকমানের মত লোভাতুর আগুন্তুক যারা প্রতিনিয়তই এভাবে টোপ গিলে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন