‘বিবেক বুদ্ধি বিলুপ্ত অন্ধ দৃষ্টিশক্তি
লোভে সৃষ্টি কাম ক্রোধে মোহে ক্ষতি’
বরাবরই লোভ
আমাকে একটু
কমই আকর্ষন করে , তবে কি আমি অতিমানব বা যোগী সাধু ! নাহ তাও নয় , যতটুকু লোভ মনুষ্য সহজাত প্রবৃত্তির ঠিক ততটুকু আমার আছে । যার ফলে শাব্দিক অর্থে শক্তি চর্চা করার পেশায় থাকার পরেও আমি অনেক রিল্যাক্স ও চিন্তামুক্ত থাকতে পারি । লোভ এমন একটি প্রপঞ্চ যা আমাদের বিবেক বুদ্ধিকে লোপ করে আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে মোহের দিকে ঠেলে দেয় সাথে সাথে ক্রোধ ও কামের অনৈতিক উত্থান ব্যাপক ক্ষতির কারন হয়ে যায় ।
তাই লোভ
সংবরন ও
লোভকে নিয়ন্ত্রনে রাখাটাই সবচেয়ে উত্তম ।
২০০৯ সালের ঘটনা , তখন
আমার পোষ্টিং ঢাকার বাইরে , ছুটি বা অফিসের কাজে ঢাকায় যাওয়া হয় , সম্ভবত বছরেরে শেষদিকের ঘটনা , ঢাকায় এসে আমাদের সেই মেট্রোপলিটনের
আড্ডা । এরমধ্যে আমার
ভার্সিটির একজন
বড় ভাই আমাকে ফোন দিলেন, আমি যেন তার সাথে দ্রুত একবার হলেও দেখা করি , পরেরদিন দুপুরে দেখা করা যেতে পারে এমন টা বললাম ।সেই ভাই
আমাকে বললেন – তার একজন
বন্ধু আছে
সুমন নামের , সেই সুমনের বিষয়ে আমার সাথে কথা বলবেন , আমি হ্যাঁ বলে দিলাম যে পরের দিন ১১ টার দিকে উনার সাথে আমার দেখা হবে এমনটাই বলে দিলাম ।
পরেরদিন যথা
সময়ে আমি হাজির হলাম মেট্রোপলিটনে , সেই বড় ভাই আর সুমন এসেছেন , বড় ভাই তার ব্যক্তিগত বিষয়টি শেয়ার করার পর আমাকে বললেন আমার বন্ধু সুমন একটা ব্যবসাতে নামছে , ওখানে তোমাকেও পার্টনার হিসেবে চাই । আমি একটু হাসি দিয়ে বললাম ভাই –বিশ্বাস করেন আমার দ্বারা ব্যবসা সম্ভব নয় আর কিসের ব্যবসা সেটা একটু জানা দরকার ।তখন সুমন
শুরু করল, স্যার জীবনে কোন ভাল কাজ করেছিলাম যে কারনে আপনার মত মানুষের সাথে পরিচয় হওয়াটা , আমি বললাম- ভাই আপনি মুল বিষয় টা আমাকে শেয়ার করেন ।সুমন
বলল –আপনি ৫০ লক্ষ টাকা পাবেন ,আমাদের পার্টনার হিসেবে , আপনাকে কোন ইনভেস্টমেন্ট করতে হবে না ।
মানে?
মানে আমাদের ৫ জনের প্রোজেক্ট ,ইন্ডাস্ট্রি এর
মত এখানে মোট ১০ কোট টাকার ইনভেস্টমেন্ট , ১০ কোটি টাকার প্রজেক্ট এ ৫০ লক্ষ টাকা দেওয়া কোন ব্যাপার !
দেড়শ গ্রাম হলে বিক্রি করা যাবে
‘হাজার কোটি’ টাকা। শুধু ‘পকেট মানিই’ দেবে দুইশ কোটি টাকা। এটা হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত। দেশের যেখানেই থাকুক না কেন সেখানই ‘বায়ার’ যাবে। হেলিকপ্টারে গিয়ে নিয়ে
আসা হবে।
মামুন ভাই
সাথে ছিলেন, তিনি মুচকি হেসে বললেন , আপনি কি তক্ষক এর কথা বলছেন , ও সাথে সাথে মাথা নাড়াল, এরপরে আমাকে তক্ষক সম্পর্কে ৩০ মিনিট এর একটা ধারনা দিলেন , সব কিছুর বিষয়ে । দুইবার নাকি তারা সিলেট থেকে এনেই ফেলছিল শুধু ডিবি পুলিশের কড়া তল্লাশীর জন্য ঐ দুইটায় তাদের হাতে চলে যায় ।
আমার কি
কাজ যে ৫০ লক্ষ টাকা আমাকে দেয়া হবে ? আপনি শুধু পুলিশের বিষয়গুলো দেখবেন, এটাই অনেক বড় কাজ হবে , আমি খুব খুব বিনয়ের সাথে আমার সেই বড়ভাই কে না করে দিলাম, বললাম –ভাই আমার অবৈধ উপায়ের ১ পয়সাও দরকার নাই ।
আমাকে ‘তক্ষক’ বিষয়টি একটা
নাড়া দিল যে এটা সম্পর্কে আমার ডিটেইলস জানতে হবে ,কি এমন
আছে এর মধ্যে যার দাম কোটি টাকার উর্ধে ?
দেখতে
গুই সাপের বাচ্চার মতো। গায়ে লাল সিঁদুরের ও সাদা ফোঁটার মতো রয়েছে। আকারে ছোট।
তক্ষক (ইংরেজি: Tokay gecko, বৈজ্ঞানিক নাম:Gekko gecko) গেকোনিডি গোত্রের একটি গিরগিটি প্রজাতি। পিঠের দিক ধূসর, নীলচে-ধূসর বা নীলচে বেগুনি-ধূসর। সারা শরীরে থাকে লাল ও সাদাটে ধূসর ফোঁটা। পিঠের সাদাটে ফোঁটাগুলি পাশাপাশি
৭-৮টি সরু সারিতে বিন্যস্ত। কমবয়সী তক্ষকের লেজে পরপর গাঢ-নীল ও প্রায় সাদা রঙের বলয় রয়েছে। মাথা অপেক্ষাকৃত বড়, নাকের ডগা চোখা ও ভোঁতা। চোখ বড় বড়, মণি ফালি গড়নের। লেজ সামান্য নোয়ানো।
দৈর্ঘ্য নাকের ডগা থেকে পা পর্যন্ত ১৭ সেমি এবং লেজও প্রায় ততটা। তক্ষকের ডাক চড়া, স্পষ্ট ও অনেক দূর থেকে শোনা যায়। ডাকের জন্যই এই নাম। কক্কক্ আওয়াজ দিয়ে ডাক শুরু হয়, অতঃপর ‘তক্-ক্কা’ ডাকে কয়েক বার ও স্পষ্টস্বরে।
এরা কীটপতঙ্গ, ঘরের টিকটিকি ছোট পাখি ও ছোট সাপ খেয়ে থাকে। ছাদের পাশের ভাঙা ফাঁক-ফোঁকড় বা গর্তে অথবা গাছে বাস করে। ব্যাপক নিধনই বিপন্ন হওয়ার কারণ। অনেকে ভুলক্রমে
তক্ষককে বিষাক্ত সরীসৃপ হিসেবে চিহ্নিত করে। দেশী চিকিৎসায়
এদের তেল ব্যবহূত হয়। ভারত ও বাংলাদেশসহ মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্পুচিয়া,
মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও ফিলিপাইনসহ
বিভিন্ন দেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির তক্ষকের বাস। বাংলাদেশে
প্রায় ২ প্রজাতির তক্ষক দেখা যায়।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এটি সরিসৃপ জাতীয় প্রাণি। এরা নিশাচর। গাছের গর্তে বাস করে। বিভিন্ন পোকামাকড়, পাখির ডিম খেয়ে এরা বেঁচে থাকে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের
প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড.
মো. আব্দুল আলীম বলেন, ‘সাউথ ইস্ট এশিয়ায় অনেকেই পোষা প্রাণির মতো তক্ষক লালন করে বলে শোনা যায়। তারা মনে করেন, এই প্রাণি বাড়িতে থাকলে তাদের সৌভাগ্য বয়ে আনে। নিঃসন্তানদের সন্তানাদি হয় ।
বাংলাদেশ থেকে
শুরু করে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত কিছু কিছু দ্বীপাঞ্চলে এই প্রাণি রয়েছে।
উইকিপিডিয়া থেকে
জানা যায়, ভারত ও বাংলাদেশসহ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্পুচিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও ফিলিপাইনসহ বিভিন্ন দেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির তক্ষকের বাস।
বণ্যপ্রাণি ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণের খুলনা বিভাগীয় বন
কর্মকর্তা বলেন,
তক্ষকের বিষয়টি আমরা এখনো
পরিষ্কার হতে
পারিনি। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে জানা গেছে,
পূর্ব এশীয়
দেশগুলোতে এই
প্রাণি চড়ামূল্যে বিক্রি হয়।
তক্ষকের ওষুধি গুণ রয়েছে বলে শোনা
যায়। কোনো কোনো দেশে এ দিয়ে ওষুধ তৈরি করে থাকতে পারে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কনজারভেশন অব বায়োলজি এবং ক্লাইমেট চেঞ্জ রিসার্স ইউনিট ‘প্রাণীবিদ্যা’ বিভাগের প্রফেসর ড. বিধান চন্দ্র দাস জানান, বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে নানারকম গুজব ছড়িয়ে সাধারণ মানুষকে তক্ষক সংগ্রহের কাজে প্রলুব্ধ করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে যে, ৩০০-৪০০ গ্রাম ওজনের কাছাকাছি একটি তক্ষকের দাম কয়েক লক্ষ বা কোটি টাকা। সাধারণ মানুষ না বুঝেই তখন তক্ষক খোঁজা শুরু করে দেয়। গুজব রটনাকারী চক্রের খপ্পরে অনেকেই তক্ষক খোঁজেন। গোটা বিষয়টি নিঃসন্দেহে ধাপ্পাবাজী। তবে ইন্দোচায়না তথা বৃহত্তর দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশে তক্ষকের কিছু চাহিদা আছে। ওই সব দেশে গৃহপালিত প্রাণি হিসেবে কিংবা ঔষধ তৈরির কাজে তক্ষক ক্রয়-বিক্রয় হয়। কিন্তু কোনোক্রমেই তা লক্ষ লক্ষ বা কোটি টাকায় নয়।’
‘জ্ঞান বুদ্ধি বিসর্জনে লোভ করে বাস
মনে ঈর্ষার অনল সদা সর্বনাশ '
যারা কোন কিছুর কার্য ও কারণ ছাড়াই বিবেচনা করে এবং যারা পরিশ্রম ছাড়াই এমন অশ্বডিম্বের হাতছানিতে সাড়া দেয় তাদের মনোজগতে জ্ঞান ও বুদ্ধির বিকাশ হয় নাই । ঘরে বসে বসে হেন করেংগা তেন করেংগা ! সবাই শুধু তক্ষক আর কোটি কোটি টাকার স্বপ্নে বিভোর অথচ কেউ এর বায়ারকে আজ পর্যন্ত চোখে দেখে নাই , অথচ আমার সেই বড় ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী হবার পরেও এই অন্ধ মোহে বিমোহিত হয়ে ঢাকায় দুই দুইটি গ্রুপ তৈরি করলেন তক্ষক এর ব্যবসা করার জন্য , এক গ্রুপ কে পাঠালেন সিলেট আরেক গ্রুপকে পাঠালেন ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ে ।
সিলেটের গ্রুপ ১০ টা তক্ষক নিয়েছে ৩ লক্ষ টাকা দিয়ে, ছাতক থেকে ওটা নিয়ে সিলেট আসার পরেই একজন ফোন দিয়ে বলতেছে –ভাই আপনারা যেটা নিয়েছেন ওটা আসল নয় , আসল টার দাম আরও এক লক্ষ টাকা বেশি , টিমের ধারনা এটা তাদের দালাল অসীম চিসিমেরই টাকা নেয়ার কৌশল । এভাবে আসার পথে সিলেটের আগেই বিজিবি তাদের মাইক্রো-বাস চেক করে তক্ষক সহ তাদের ৫ জনকে গ্রেফতার করে । এরপরে আমার সেই বড় ভাই আমার কাছে এই বিষয়ে সাহায্য চাইলে আমি সোজা না করে দেই এবং সিলেটে ফোন করে বলে দেয় এদের বিরুদ্ধে খুব কড়া ব্যবস্থা যেন নেওয়া হয় ।
প্রায় সেইম সময়ে সেই ভাই এর নিজের ব্যবহৃত প্রাইভেট কার ৪ জনের আরেক গ্রুপকে দেয় ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট যাবার জন্য , পথিমধ্যে গৌরীপুরের কোন এক স্থানে গাড়ি থামিয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার সময় একে অন্যের সাথে টাকা নিয়ে ঝগড়া শুরু করে , এক পর্যায়ে ঐ গ্রামের লোকজন অচেনা ৪ জন ছেলে , প্রাইভেট কার , কারের ভিতরে ৩ লক্ষ টাকা এসব দেখে সন্দেহে তাদের ঘেরাও করে প্রথমে উত্তম মধ্যম দেয়ার পরে তাদের কে পুলিশে সোপর্দ করে , পুলিশের কাছে তারা কেউ সন্তোষজনক কোন জবাব দিতে না পারায় তাদেরকে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে আরেকবার উত্তম মধ্যম দেয়ার পরে চালান দেয়া হয় এবং আমার সেই বড় ভাই এর গাড়িটি কে নাশকতার আলামত হিসেবে জব্দ করা হয় ।
আমার সেই ভাই ২ মাস জেল খাটার পরে জামিনে বের হয়ে আমার সাথে দেখা করতে আসলে আমি শুধু একটি কথা বলি – লোভ মানুষকে পাপ কাজের সাথে নেয় আর পাপ কাজ সর্বনাশ ডাকে , এর প্রমাণ আপনি নিজেই । তিনি শুধু বললেন –ভাই আর লজ্জা দিও না , জীবনে অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল । এখন কি এই ক্ষতি থেকে কোন শিক্ষা আপনি পেলেন –সেই ভাই কে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তিনি মাথা নাড়লেন।
আমি বললাম –
মনের ভিতরের কালো জিনিসগুলো ফেলে দেন চিরতরে , কলুষিত মনে সদা সর্বনাশ বিরাজ করে , লোভ, মোহ ,নৈতিক ও অনৈতিকতার বিচার করেই পথ চলা উচিত । কারণ কবির ভাষায় –
'কলুষিত মনে লোভ ধোঁকা দেয় নিত্য
লোভে পাপ পাপে মৃত্যু চিরন্তন সত্য '