শুক্রবার, ২৪ মার্চ, ২০১৭

পঁচিশে মার্চের কালো রাতে বীর পুলিশের গল্প



দুর্বার পথে উদ্দীপ্ত জওয়ান 
সন্ধ্যায় ডাক এসেছে আহবান 
মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর ফরমান 
অস্ত্র বিলিয়ে রাজারবাগে হও আগুয়ান । 
তোমার মর্মরধ্বনি উদ্দাম উচ্ছ্বাসে 
রাজারবাগে প্রলয় মহাসমুদ্র জাগে । 

তুলে দিতে হাতে হাতে 
বুকের অসীম সাহস ধরাতে, 
হবে প্রতিরোধ সন্মুখ পচিশের কালো রাতে । 
বিশেষ সহকারী গোলাম মোর্শেদ এনেছেন সেই বার্তা 
বঙ্গবন্ধুর আহবানে স্বাধিকারের প্রথম উদ্দাম জয়যাত্রা। 
ঘণ্টা বাজিয়ে আব্দুল আলী খান 
পাকসেনাদের আক্রমণের আগাম আভাস দেন । 

বীর পুলিশেরা উদ্দাম ভয়হারা 
অস্ত্রাগারের দ্বারে  দ্বারে তখন 
জওয়ানেরা বারে বারে 
খুঁজে ফিরে ভেঙ্গেছে দ্বার মুক্তির জোয়ারে । 
লুটিয়ে অস্ত্র হাতে হাতে 
সার্জেন্ট মর্তূজা সাথে সাথে   
সালামী গার্ডে উড়িয়ে পতাকা অবাক অভ্যুদয় 
দুর্জয় দুর্বার স্যালুট সমগ্র রাজারবাগময় । 

চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বীর পুলিশের দল 
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ ব্যাংকার আর ছাদে থ্রি নট থ্রির নল, 
প্রথম বুলেট ছুটে গেল হানাদারের কনভয়ে 
শান্তিনগরের ডন স্কুলের ছাদে, 
সেই বীর পুলিশের ট্রিগারে, সূচিত প্রথম প্রতিরোধ । 

ভেসে এলো বেতার বার্তা  অপারেটর শাহজাহানের , 
উদ্দীপ্ত কালজয়ী সেই মেসেজে, 
ছড়িয়ে গেল  মুক্তিযুদ্ধ সারাদেশে , 
-base for all station of east Pakistan  police 
keep listening , watch,   
we are already attacked by  pak army , 
try to save yourself , over   

সেই কাল রাতে আধুনিক অস্ত্রে হানাদারেরা সম্মুখে 
স্বাধিকারের বীজ রাজারবাগের হাজার পুলিশের  বুকে , 
তবুও বীর পুলিশের থ্রি নট থ্রির উচ্ছল 
কালের সাক্ষী প্রথম প্রতিরোধ আর প্রথম দাবানল । 

বাবর আলী,  মহিউদ্দিন, আব্দুল আলী, 
শাহজাহান মিয়া আর ইমান আলী সহ 
নাম না জানা আরো হাজার বীরেরা, 
শুধুই জেনো বীর পুলিশেরা তোমরা আজো দুর্জয় দুর্বার , 
তোমাদের পদাঘাতে তোমাদের হাতে উদ্দাম জয়যাত্রার পথে   
সূচনা হয়েছে মুক্তির  দ্বার। 

ট্রেসার বুলেট  আর ফ্লেয়ার ম্যাগনেসিয়াম 
তিমির আকাশে আলো দিয়ে ফুটিয়েছে দেশপ্রেম ,   
তোমাদের  রক্ত , তোমাদের আত্মদান উন্নত শির রবে 
বীর পুলিশের এগিয়ে চলার শৌর্য বীর্যের  উৎসবে। 

তবুও আত্মপ্রত্যয়,  তোমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম  রয়েছ পাশে, 
বীর পুলিশেরা তোমরা রয়েছ বাংলাদেশের  নিঃশ্বাসে। 
উদ্দাম জয়যাত্রার পথে জেনো গড়েছ দেশপ্রেম নিবিড় 
জ্বালাব বাতি মুক্তির সারথি হাজার কোটি স্যালুট 
তোমার পানে নত শির জানাই পুলিশ শ্রেষ্ঠ বীর । 

(inspired by documentary named  ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রতিরোধ ‘ 
উৎসর্গ- জ্ঞাত সংখ্যায়  ১২৬২ জন পুলিশ সদস্য , ডিআইজি থেকে কনস্টেবল পদের যারা দেশের তরে জীবন দান করেছেন, সেইসব  বীরদের স্মরনে )


সোমবার, ১৩ মার্চ, ২০১৭

আরআই এর কান্না


২০০৬ সালের আগস্ট মাস , তখন আমি ময়মনসিংহের গফরগাঁও সার্কেল এএসপি । ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে  দুই বছর পূর্ণ হল । চাকুরীতে   নবীন হবার জন্যে তখনও ঊর্ধ্বতনদের সাথে পুলি-শিং কিভাবে সন্মোধন করতে হয় তা সম্পূর্ণ ধাতস্থ হয়ে উঠেনি আর উঠেনি বলে একটি যৌক্তিক গ্রেফতারের পরে  ঊর্ধ্বতনের আদেশকে কিভাবে বইতে হয় তা না জানা বা বোঝার জন্যে  সেপ্টেম্বর মাসে আমার  বদলি হল রংপুর পিটিসিতে । আমার স্ত্রী তখন সন্তান সম্ভবা , আমার ছেলের জন্ম হয়নি তখন ও। এমন অবস্থায় এই বদলি টি আমার জন্যে ভীষণ পীড়াদায়ক হয়ে উঠল, আমার স্ত্রীর তখন ৮ মাস চলছে এই অবস্থায় তাকে ছেড়েই আমাকে যোগদান করতে হল রংপুর পিটিসিতে । যদিও মাত্র ৩২ দিন স্থায়ী ছিল এই বদলি , ৩২ দিন পরেই আমার বদলি হয় ঢাকার কাছাকাছি মুন্সীগঞ্জ জেলা তে ।

 যাই হোক সেই সময়ের পিটিসি রংপুরের কথা বলছিলাম-  সারাক্ষণ মনমরা হয়ে থাকি , আমার পদ হল সিএলআই চীফ লয়ারস ইন্সট্রাক্টর । সার্কেল এএসপি হিসেবে যেখানে ২৪ ঘণ্টায় ভীষণ ব্যস্ত থাকতে হয় সেখানে পিটিসি তে দুপুর দুইটার পরে আর কোন কাজ থাকে না । কমান্ডেন্ট ও ডিপুটি কমান্ড্যান্ট স্যার দুজনেই লেডি অফিসার হবার কারণে মসজিদ ও ঠিকাদারি বিষয়গুলি আমাকে দেখতে হত, যার ফলে কিছুটা কাজ বাড়ল , ধীরে ধীরে এসব কার্যক্রমগুলোর সাথে আমার যোগসূত্রতা  বাড়তে লাগল, এরমধ্যে এইচ আইভি এইডস বিষয়ক একটি সেমিনার সহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ আয়োজন করতে লাগলাম , এরমধ্যে হঠাৎ করে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স থেকে তৎকালীন ডিআইজি(ট্রেনিং) স্যার এলেন , টিআরসিদের ট্রেনিং কার্যক্রম দেখতে ।  

আমরা ২/৩ দিন স্যারের আসার প্রস্তুতিমুলক কাজে খুব ব্যস্ত থাকলাম , এরমধ্যে নির্দিষ্ট দিনে স্যার এলেন স্যার কে ড্রিল-শেডে নিয়ে গেলাম, সেখানে স্যার টিআরসি দের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা শুরু করলেন
‘’আমার সামনে বসে আছেন ভবিষ্যৎ রমনা থানার ওসি , আমার সামনে বসে আছেন ভবিষ্যৎ গুলশান থানার ওসি, আমার সামনে বসে আছেন   ভবিষ্যৎ মতিঝিল  থানার ওসি, মানে ডিএমপি এর সব থানা গুলো বললেন , আরও বললেন এখানে রয়েছে আমার এস-পি অফিসের আরও , এখানে রয়েছ তোমরা ভবিষ্যৎ আর আই , এই তো আমি ক্লিয়ার দেখতে পাচ্ছি, কমান্ড্যান্ট স্যার কে দেখে মনে হল স্যার জিবে কামড় দিয়ে আছেন আমিও হাঁসি থামাতে পারছিনা স্যারের উপমাগুলোর  ভঙ্গী দেখে । আমি ড্রিলের পিছনে গিয়ে একা একা কিছুক্ষণ হাসলাম কিন্তু কিছুক্ষণ পরে মনে হল এটাও স্যারের প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে ঢুকবার একটা মাধ্যম হতে পারে যা ঐ সময় সবাইকে হাসালেও এর একটি মর্মার্থ আছে । 

সত্যি তো এখনকার ৬০০ ট্রে-ইনি কনস্টেবলের মধ্যে কেউ ওসি কেউ আরও আর কেউ আরআই বা কেউ  এএসপি হবেন , আমার সাথে সাথেই পুলিস লাইন্সের সদ্য বিদায়ী আরআই এর কথা মনে হল যিনি এখন এএসপি, সেটা এক স্মরণীয় ঘটনা আমার কাছে- আরআই আমার অফিসে এসেছেন কি একটা কাজেআমি মেইল চেক করতেছি হঠাৎ করে দেখি প্রমোশনের মেইল , আরআই এএসপি পদে পদোন্নতি পেয়েছেন, সাথে সাথে তাকে এই সুখবরটি দেওয়ার পরে তিনি চোখ মুছতে লাগলেন, শুধু বললেন স্যার- আমি কনস্টেবলে ভর্তি আজ আমি এএসপি কোনদিন ভাবি নাই , আমার চাকুরী আছে আর একবছর,--

আরআই এর এই চোখের অশ্রু সুখা-প্লুত এবং এই অশ্রু সফলতার, এই অশ্রু ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছরের ডিসিপ্লিন পেশাদারিত্ব আর ভাল সার্ভিস রেকর্ডের ফল । যে যেই পদেরই হোক না কেন অভিজ্ঞতা ও কাজ জানার কোন বিকল্প নেই । 

২০১৩ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে আইভরিকোষ্টে ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে কর্মরত ছিলাম। এক বছরের মিশন অভিজ্ঞতাতে দেখেছি যারা বিশেষ ভাবে দক্ষ অর্থাৎ ট্রেডের তাদের কত কদর, ট্রেড মানে প্লাম্বার, জেনারেটর অপারেটর ,ড্রাইভার , মেডিক্যাল সহকারী , ক্লথিং মাস্টার সহ আরও অনেক গুলো পদ যা মিশনে যাবার পূর্বশর্ত হিসেবে গণ্য , আমাদের সাথে দীনেশ চাকমা নামে একজন নায়েক ছিলেন, যার পদ ছিল ইলেক্ট্রিশিয়ান , এই ছেলেটির কথা বলার একটাই কারণ সে এমন কোন কাজ নেই যা পারে না, রান্না থেকে শুরু করে গাড়ি চালনা পর্যন্ত , অল্পদিনের মধ্যে তার নাম দেয়া হল মহাবীর দীনেশ এবং তাকে বিমান চালনা দেখায় দিলে নাকি সেটাও পারবে ! পারুক বা না পারুক তার এই আত্মবিশ্বাস কয়জনের আছে ? আমাদের যারা ট্রে-ইনি রিক্রুট কনস্টেবল আছেন আমি চাই আমার এই লেখা তাদের সবার জন্য হোক এক বিশাল প্রণোদন , হোক উপরে উঠার প্রেরণা ,হোক পরিবর্তিত নতুন যুগের পুলিশ, হোক সামাজিক যোগাযোগ ফেসবুক   টুইটার   আর ইউটিউব যুগের যুগোপযোগী । সেই প্রত্যাশা রইল ।