রবিবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৭

অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো : প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধ ও নিভৃতচারী বিচারের বাণী




কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রশ্নযা পরিশেষেকাব্যের অন্তর্গত । আলোহীন বিষাক্ত মানবসমাজের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের পানে কবি ছুড়ে দিয়েছিলেন এই প্রশ্ন যা সত্য , সুন্দরের ও আলোর জয়যাত্রা ।

''ভগবান, তুমি যুগে যুগে দূত পাঠায়েছ বারে বারে
দয়াহীন সংসারে---
তারা বলে গেল `ক্ষমা করো সবে', বলে গেল `ভালোবাসো---
অন্তর হতে বিদ্বেষবিষ নাশো'
বরণীয় তারা, স্মরণীয় তার, তবুও বাহির-দ্বারে
আজি দুর্দিনে ফিরানু তাদের ব্যর্থ নমস্কারে॥

প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধ ও নিভৃতচারী বিচারের বাণীর যে প্রশ্নবাণ সেই বান থেকে  আজো আমাদের রাষ্ট্র সমাজ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ রূপে বের হতে পারেনি  যার ফলে বিচারহীনতা আজো ভিন্নরূপে বিদ্যমান । আর এর ফলে সাজার হার আশংকাজনক-ভাবে হ্রাস পাচ্ছে , প্রকৃত অপরাধীরা যেমন পার পেয়ে যাচ্ছে তেমনি নিরীহ মানুষেরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন । সেই লক্ষ্যেই জেলা আইনগত সহায়তা কার্যক্রম ,
 চলমান বিচার প্রক্রিয়ায় প্রায়শই দরিদ্র, নিরক্ষর, অসচেতন ও সুবিধা-বঞ্চিত জনগোষ্ঠী তাদের দাবি/ আইনগত অধিকার কিংবা ন্যায় বিচার প্রেক্ষিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে না। এক্ষেত্রে তাদের আর্থিক দৈন্য ও যথাযথ আইনি জ্ঞানের অভাব অন্তরায় হিসাবে কাজ করে।এই বাস্তবতার নিরিখেই রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রের সরকার দরিদ্র, সুবিধা বঞ্চিত, নিপীড়িত/ নির্যাতিত অসহায় জনগোষ্ঠীর আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত কল্পে কিংবা ব্যক্তি অধিকার সুমন্নত রাখতে রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনগত সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে জাতীয় আইনগত সহাযতা প্রদান সংস্থানামে একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা আইন করে প্রতিষ্ঠা করেন।এই সংস্থার তত্ত্বাবধানে/ অধীনে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গঠিত লিগ্যাল এইড কমিটিআইনি সহায়তা প্রদান কার্যক্রমে যুক্ত আছেন যাদের মাধ্যমে আইনি সহায়তা প্রত্যাশী ব্যক্তি/ ব্যক্তিদেরকে রাষ্ট্রীয় খরচে আইনজীবী প্রদান কিংবা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে আইনি পরামর্শ/ সহায়তা দেওয়া হয়ে থাকে প্রত্যেক পর্যায়ের কমিটিতেই সদস্য হিসেবে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য সাধনে পুলিশ সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।

জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি সহ উপজেলা/ইউনিয়ন পর্যায়ে গঠিত কমিটি কিংবা অন্য ইউনিটের কমিটি গুলোর সম্মুখে যখন সমাজের বঞ্চিত, শোষিত, নির্যাতিত ও অবহেলিত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যগণ তাদের অসহায়ত্বে ভরা আকুতি নিয়ে হাজির হন তখন তাৎক্ষণিক-ভাবে কিংবা পরবর্তীতে পুলিশ তার আইনগত ও প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্য থেকে সর্বোচ্চ সেবা প্রদানের প্রয়াস নিয়ে থাকেন। থানায় জিডি/ মামলা করেন, বিচার বিভাগের রায়/ নির্দেশনা কার্যকরণে, আপোষ-মীমাংসা/ দ্বন্দ্ব নিরসনে, প্রভাবশালীদের শোষণ/ নির্যাতন/ নিপীড়নের হাত হতে শোষিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা প্রদানে লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য হিসেবে অন্যান্য বিভাগ/ সংস্থার মত পুলিশও তার দায় দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করে থাকেন। মূলত: আইনগত সহায়তা কার্যক্রম তখনই সার্থক হবে যথন ন্যায়বিচার প্রাপ্তির করিডরে সুবিধা সঞ্চিত সকলের গম্যতা নূন্যতম হলেও অবারিত ও নিশ্চিত হবে।



ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় বিচার প্রশাসন  ও পুলিশের ভূমিকা
ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় বিচার প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও স্বাস্থ্য বিভাগ একে অপরের পরিপূরক। এর যে কোন একটি
অঙ্গ আইনে নির্ধারিত কর্মপরিধি সম্পন্ন করতে অবহেলা করলে তা সম্পূর্ণ বিচার ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব ফেলে যা কোন ভাবেই
কাম্য নয়। আইনের শাসন বাস্তবায়ন এবং মানবাধিকার সংরক্ষণ করার জন্য সকল বিভাগের মধ্যে পারষ্পরিক সহযোগীতা বৃদ্ধি
ও সমন্বয় অপরিহার্য । ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা তিনটি প্রাথমিক এবং পরিমাপযোগ্য উপাদান দ্বারা গঠিত:
 ১।আদালত ২। পুলিশ  এবং ৩। সংশোধন।
এই উপাদানগুলিকে কখনও কখনও সাব-সিস্টেম হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার
 উপাদানগুলো আন্তঃ-স্পন্দিত, পরস্পর নির্ভরশীল এবং একটি সমন্বিত
 লক্ষ্য অর্জনের যৌথ  প্রচেষ্টা বলা যেতে পারে ।পুলিশ ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় একটি বিশেষ স্থান ধারণ করে। আইন
প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকাণ্ডগুলি শুধুমাত্র পুরো ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে না, পুলিশকে এই
সমন্বিত ব্যবস্থার  "দ্বার রক্ষী’’ বলা হয় । তারা সাধারণত অভিযুক্ত অপরাধীদের সাথে প্রথম যোগাযোগ করেন এবং সেইসব
ব্যক্তিদের কে কোন আইনের আওতায় নেয়া উচিত সেই  সিদ্ধান্ত পুলিশ নেয় । এজন্য প্রায় বলা হয় পুলিশ হচ্ছে প্রাথমিক বিচারক ।



বাংলাদেশে ফৌজদারি মামলায় সাজার হার

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান ঢাকার পাঁচটি আদালতের এক বছরে নিষ্পত্তি হওয়া মামলার ওপর জরিপ করেছেন৷ তাতে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ শতকরা ১৫ থেকে ১৬ ভাগ মামলায় অপরাধীরা শাস্তি পেয়েছে৷ আর ঐ তথ্যের সঙ্গে তিনি পুলিশ সদরদপ্তর থেকে তথ্য নিয়েও মিলিয়ে দেখেছেন৷ তাতেও ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তির হার একই রকম৷
তিনি বলেন  মামলার তদন্তে দক্ষতার অভাবই বিচার না পাওয়ার প্রধান কারণ৷ আদালতে মামলা প্রমাণ করতে হলে মামলাটি প্রমাণ করতে হয় সাক্ষ্যপ্রমাণ দিয়ে৷ তাই তদন্তে যখন দুর্বলতা থাকে তখন সেটাই প্রধান গলদ৷'' তবে এর বাইরে দুর্নীতি, রাজনৈতিক প্রভাব, ক্ষমতার প্রভাব কারণ হিসেবে কাজ করে৷ কিন্তু তদন্তের দক্ষতার অভাব এটিই প্রধান কারণ৷ তিনি বলেন, ‘‘দক্ষ এবং পর্যাপ্ত জনবলসহ তদন্ত এবং বিচারব্যবস্থা ঢেলে সাজানো ছাড়া এ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় নেই৷''



অভিযোগ প্রমাণে পুলিশের  খতিয়ান

পুলিশ সদরদপ্তরের এক হিসেবে দেখা যায়, পুলিশ অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারায় ৭৬ শতাংশ মামলার ক্ষেত্রে আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে৷ বাংলাদেশে গড়ে প্রতিদিন ৫০০ ফৌজদারি মামলা হয়৷ সিআইডির প্রকাশিত তথ্যে দেখা গেছে, ২০১১ সালে সারা দেশে বিভিন্ন মামলায় ২৪ শতাংশ অপরাধীর সাজা হয়েছে৷ ৭৬ শতাংশ মামলার ক্ষেত্রে আসামির বিরুদ্ধে পুলিশ অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি৷ তবে ২০০৯ সালে সাজার হার ছিল ২৩ শতাংশ৷ এ সময় পুলিশ তদন্ত করে ৪১ শতাংশ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছে৷ বাকি মামলার আসামিরা তদন্ত পর্যায়েই অব্যাহতি পেয়েছে৷
অপহরণ মামলার ক্ষেত্রে এই চিত্র আরও ভয়াবহ৷ দেখা গেছে, গত ২৫ বছরে নিষ্পত্তি হওয়া ২১২ অপহরণ মামলার মধ্যে ১৯০ মামলাতে খালাস পেয়েছে আসামিরা৷ সাজা হয়েছে মাত্র ২১ মামলায়৷ ৯০ শতাংশ আসামিই এসব মামলায় খালাস পেয়েছে৷ এসব মামলায় ২,১০৩ জন আসামি ধরা পড়লেও দুই হাজার আসামিই জামিনে বেরিয়ে যায়৷ আর গত ১২ বছরে সারা দেশে দায়ের করা ২৭,০৮০টি অপহরণ মামলা হয়েছে৷ ঢাকার আদালতগুলোতে বিচারাধীন ২,৩৭৯টি অপহরণ মামলার মধ্যে ১২ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে ৬১২টি মামলার বিচার কাজ৷


নির্যাতনের শিকার ২২,৩৮৬ জন, শাস্তি পেয়েছেন ১০১

২০১৬ সালের মে মাসে একটি জরিপের ফল প্রকাশ করে মহিলা ও শিশু-বিষয়ক মন্ত্রণালয়৷ তাদের অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রামের' আওতায় ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, খুলনা, সিলেট, রংপুর ও ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯ বছরে ২২,৩৮৬ জন নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নেন৷ এই ঘটনাগুলোর বিচারিক প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে এ সব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৫,০০৩টি৷ রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের৷ শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার ০.৪৫ শতাংশ৷ আর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালগুলোতে গড়ে মাত্র শতকরা চারভাগ অপরাধী শাস্তি পায়৷
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, জানুয়ারি ২০১২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত নারী-শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩) এর আওতায় ২,০৯৫টি মামলায় নিষ্পত্তি হয়েছে ৩৭৪টি৷ নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় আসামি ছিলেন ৪১০ জন৷ সাজা ২৭ জন পেলেও ৩৮০ জনই খালাস পেয়ে যান৷ এরমধ্যে প্রতারণা এবং ধর্ষণ মামলা বেশি৷
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব মতে, গত ১৫ বছরে তাদের মামলায় দুই-তৃতীয়াংশ আসামি খালাস পেয়েছে৷ ২০০১ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৩৫,০১০ জন আসামি খালাস পায়৷ আর সাজা পেয়েছে ১৮ হাজার আসামি৷
দুর্নীতি দমন কমিশনের মামলারও একই অবস্থা৷ অধিকাংশ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে যান৷ বিগত বছরের আগস্ট পর্যন্ত ১২৫টি মামলার মধ্যে ৬৬ মামলার আসামিরা খালাস পেয়েছেন৷ ২০১৫ সালে ৩০৬ মামলার ২০৭টিতেই আসামিরা খালাস পান৷


নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে সাজার হার
নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে দেশে প্রতি বছর হাজারো মামলা হলেও মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাজা পাওয়ার হার এক শতাংশেরও কম। দেশের তিনটি জেলায় ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার ৭৩টি মামলার নিষ্পত্তি হলেও এতে সাজা পেয়েছেন মাত্র ১৮৬ জন। সাজা পাওয়ার হার দশমিক ৯৪ শতাংশ।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই তথ্য দেওয়া হয়েছে। ঢাকা, কুমিল্লা ও পাবনা জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতের মামলা পর্যালোচনা করে তারা এই প্রতিবেদন তৈরি করেছে। প্রতিবেদনটি আজ বুধবার রাজধানীর ব্র্যাক ইন সেন্টারে প্রকাশ করা হয়।
গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক তানজিনা শারমিন ও আতিয়া নাজনীন। গবেষণা কাজে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়কে সহযোগিতা করেছে যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিভাগ (ইউকেএইড) ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি)।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৯ সালে ঢাকা, কুমিল্লা ও পাবনা জেলায় বিচারাধীন মামলা ছিল ৮ হাজার ৭২৭টি। ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৪৭৪-এ। এ সময়ে মোট মামলা হয়েছে ৩৭ হাজার ৯১৫টি।
ছয় বছরে মোট মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ২২ হাজার ৭৩টি। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ২ হাজার ৬০৮ টি,২০১০ সালে ২ হাজার ৬৪২ টি,২০১১ সালে ৩ হাজার ৩২ টি,২০১২ সালে ৪ হাজার ২৭৯ টি,২০১৩ সালে ৪ হাজার ৯৭০টি এবং ২০১৪ সালে ৪ হাজার ৫৪২টি।
নিষ্পত্তি হওয়া মামলায় সাজা পেয়েছেন মাত্র ১৮৬ জন। এর মধ্যে ২০০৯ সালে ৫৪ জন, ২০১০ সালে ৪৮ জন, ২০১১ সালে ২৩ জন, ২০১২ সালে ২৭ জন, ২০১৩ সালে ১৫ এবং ২০১৪ সালে ১৯ জন। ২০০৯ সালে সাজা পাওয়ার হার ছিল ১ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে দশমিক ৪০ শতাংশে।
প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী ছয় বছরে মামলা নিষ্পত্তির হারও সন্তোষজনক নয়। ২০০৯ সালে মামলা নিষ্পত্তির হার ছিল ২১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা এসে দাঁড়িয়েছে ২২ দশমিক ২৮ শতাংশে। সবচেয়ে বেশি ৪ হাজার ৯৭০টি (২৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ) মামলা নিষ্পত্তি ২০১৩ সালে।
একই সময়ে মামলা থেকে খালাস পান ১২ হাজার ৫৪ জন। ২০০৯ সালে মামলা থেকে খালাস পাওয়ার হার ছিল ৯৮ দশমিক ০৮ শতাংশ। ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯ দশমিক ৬০ শতাংশে।

আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, এই প্রতিবেদন থেকে প্রতীয়মান হয়, বিচার প্রক্রিয়া ও ত্রুটিপূর্ণ দুর্বল তদন্ত প্রতিবেদনের কারণে সিংহভাগ অভিযুক্ত ব্যক্তি মামলা থেকে খালাস পেয়ে যান। ছয় বছরে ২২ হাজারের বেশি মামলায় সাজা হয়েছে মাত্র ১৮৬ জনের। এটি বিস্ময়কর। তিনি আরও বলেন, আদালতের রায় অনুযায়ী ৯৯ শতাংশ অভিযুক্ত ব্যক্তি নির্দোষ। কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী এদের নিশ্চিতভাবে তিন মাস জেলা খাটতে হয়েছে। তারা যে বিনা অপরাধে জেলা খাটলেন তার প্রতিকার কি?
কবি গুরুর ভাষায়

''আমি-যে দেখেছি প্রতিকারহীন শক্তের অপরাধে
               বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে
আমি-যে দেখিনু তরুণ বালক উন্মাদ হয়ে ছুটে
কি যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে নিষ্ফল মাথা কুটে।
 

বিচারহীনতার কারণ

বাংলাদেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির প্রধান কারণগুলো হলো

১. রাজনৈতিক এবং ক্ষমতার প্রভাব
২. দুর্নীতি
৩. মামলার তদন্তে অদক্ষতা
৪. অপরাধ দমন, তদন্ত এবং বিচারিক প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত জনবলের অভাব
৫। মিথ্যা মামলা রজু
৬) সাক্ষ্যের উপস্থিতির অভাব 
৭)কোর্টের  বাইরে সেটেলমেন্ট
৮)দুর্বল পুলিশ তদন্ত
৯)মামলা জট
১০)প্রসিকিউশন এর অসন্তোষজনক ভূমিকা


মামলা জটের চক্র ও বিশ্লেষণ

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায়  মামলাজটের কারণে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে । প্রতিদিন বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন থানায় প্রায় ছয় শত মামলা মামলা রুজু হয়। এগুলো সবই ধর্তব্য অপরাধের মামলা। এর বাইরেও রয়েছে অর্ধতব্য ফৌজদারি মামলা ও সিআর আমলা। আদালতে রুজুকৃত মামলাগুলোর সঠিক পরিসংখ্যান আমার জানা নেই। এগুলোর বিচার বিভাগীয় অনুসন্ধান হতে পারে কিংবা আদালত কোন প্রকার অনুসন্ধান ছাড়াই অপরাধ আমলে নিয়ে প্রসেস ইস্যু করতে পারেন।

অন্যদিকে আদালতে রুজু হওয়া ধর্তব্য অপরাধের যে সকল মামলা পুলিশের কাছে তদন্তের জন্য পাঠানো হয়, বিশেষ করে নারী ও নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল, এসিড অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল থেকে আসা ধর্তব্য অপরাধের মামলাসহ গোটা বছর পুলিশের খাতায় যে সব মামলা রুজু হয়, একই বছরে সে সব মামলার শতকরা ৮৫ ভাগের তদন্ত শেষ হয়। অর্থাৎ বছর শেষে পুলিশের কাছে তদন্ত মুলতবি মামলার শতকরা হার হল মাত্র ১৫।

কিন্তু আসল জটটি শুরু হয়, মামলা যখন তদন্ত শেষে প্রতিবেদন দেয়া হয়। এখানে একটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য যে পুলিশের পরিসংখ্যানে উল্লেখিত মামলাগুলোর প্রায় ৪০% চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমে শেষ হয়। অনেক সময় অধিকতর তদন্তের জন্য আসা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের মামলাগুলো অভিযোগ পত্রের মাধ্যমে শেষ হয়। সেক্ষেত্রে আদালতের কাছে বিচারের জন্য প্রেরিত মামলার সংখ্যা পুলিশের খাতায় রুজুকৃত মোট মামলার ৬০% এর একটু বেশি হবে।

কিন্তু তারপরও আদালত মামলার ভারে জর্জরিত। আদালতের কাছে মুলতবি মামলার সংখ্যা নিয়ে কিছুটা গরমিল থাকলেও সংখ্যাটি যে দুই লক্ষাধিক এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। অনেক সূত্র দাবি করে এ মুহূর্ত থেকে যদি বাংলাদেশের থানা বা আদালতে মামলা রুজু বন্ধ করে দেয়া হয়, তবুও আদালতের হাতে বিচারাধীন যে সব মামলা আছে সেগুলোর বিচার শেষ করতে প্রায ৮৫ বছর সময় লাগবে। তথ্যটি একটি অনুমান প্রকল্প হলেও আদালতে মামলা জটের ভয়াবহতা প্রমাণের জন্য এটা একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
আদালতে মামলার জট নিরসনের জন্য নানা মহল থেকে নানা ধরনের পরামর্শ ও পন্থা  দেয়া হচ্ছে।  পরামর্শগুলোর সারমর্ম নিম্নরূপ:
•         বিচারকের সংখ্যা বৃদ্ধি করা,
•         সাক্ষী উপস্থাপনে পুলিশকে আরও বেশি তৎপর হওয়া,
•         সরকারি ও বিরোধী উভয় পক্ষের আইনজীবীদের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আন্তরিক হওয়া,
•         অধিক সংখ্যায় ও অধিক শ্রেণির মামলাকে সকল স্তরেই মীমাংসা-যোগ্য করা,
•         দোষস্বীকারের জন্যে আসামীকে শাস্তির ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া যাতে অভিযোগ গঠনের দিনই মামলাটির নিষ্পত্তি হয়,
•         সরকার পক্ষের মামলা পরিচালনার জন্য বর্তমানের রাজনৈতিক বিবেচনায় অস্থায়ী সরকারি কৌশলী নিয়োগের পরিবর্তে      স্থায়ী প্রসিকিউশন ক্যাডার/সার্ভিস তৈরি,
•         বিচারক, পাবলিক প্রসিকিউটর ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের সাথে সহযোগিতা বৃদ্ধি,
•         আদালতের দক্ষতা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি,
•         পুলিশের অপারেশন ও সাক্ষী উপস্থাপনের দক্ষতা বৃদ্ধি, ইত্যাদি ইত্যাদি।

মামলা জট কমানোর ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসেবে বর্তমানে গ্রাম আদালত একটি আলোচিত সরকারি উদ্যোগ। গ্রাম আদালত ইউনিয়ন পরিষদের  নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত পাঁচ সদস্যের একটি আইনি আদালত সাধারণত  যার প্রধান থাকেন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। ৭৫ হাজার টাকা পর্বন্ত আর্থিক সংশ্লিষ্টতা সম্পন্ন ফৌজদারি মামলাসহ দণ্ড বিধির অধীন বেশ কিছু অপরাধের বিচার গ্রাম আদালতে সম্পন্ন হতে পারে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত যে কোন পরিষদের মতো  ইউনিয়ন পরিষদের প্রতি সাধারণ আস্থাহীনতার জন্য গ্রাম আদালত কার্যকর হতে পারছে না।

অধুনা বিচারের নীতি হিসেবে পুনর্ভরণমূলক(Restorative) বিচারের কথা বলা হচ্ছে। এ ব্যবস্থায় বাদী ও বিবাদীদের সম্মতিক্রমে কোন সংঘটিত অপরাধমূলক ঘটনার ফলে উদ্ভূত ক্ষতি বিবাদী পক্ষ কর্তৃক পুষিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। অপরাধী তার দায় স্বীকার করে ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ ক্ষতিপূরণ গ্রহণের শর্তে বিষয়টি কমিউনিটি স্তরেই মীমাংসা করতে রাজি হয়।  এ ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক বিচার কাঠামোতে প্রবেশের পূর্বেই মামলাটির নিষ্পত্তি হয়। আর এই নিষ্পত্তিতে বাদী-বিবাদী ও কমিউনিটির মানুষ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। পুলিশ অফিসারগণ এখানে বিচার প্রক্রিয়ার সূচনাকারী, প্রভাবক, মধ্যস্থতাকারী ও অভিভাবক হিসেবে কাজ করেন। গ্রেট ব্রিটেনের বেশি কিছু পুলিশ অধিক্ষেত্রে যেমন নরফোর্ক পুলিশ বিভাগে এধরনের বিচার ব্যবস্থার অনুশীলন হচ্ছে।

মামলাজট পাকানোতে আদালতে সরকারি ও বিরোধী উভয় পক্ষের কৌসুলিদের যথেষ্ট অবদান রয়েছে। নিন্দুকেরা বলে থাকেন আইনজীবীগণ চান না তার মক্কেলের মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। কারণ, একটি মামলার নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া মানেই হল উকিল সাহেব একজন মক্কেল হারালেন। অনেকে বলেন, একজন মক্কেল উকিলের কাছে দুধাল গাইয়ের মতো। মক্কেলের মামলা নিষ্পত্তি করা মানেই হল দুধ দেয়া গাইটির গলায় ছুরি চালান !

দেশের বিচার ব্যবস্থার অন্যতম অনুষঙ্গ হল আইনজীবীগণ। কিন্তু আইনজীবীগণ প্রত্যক্ষভাবে দলীয় রাজনীতিতে জড়িত। তাই দলীয় রাজনীতির যত গুণ ও দোষ আছে সেগুলোর সবই আইনজীবী মহলে বিদ্যমান। হরতাল, ধর্মঘট, দলীয় কর্মসূচি ইত্যাদির সবগুলোই বিচার ব্যবস্থাকে স্থবির করে দেয়। হরতালে অফিসে কাজ হয়, যোগাযোগ ব্যবস্থাও চালু থাকে। কিন্তু সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে আদালতের বিচার কার্য। আসামী-ফরিয়াদি, বিচারক সাক্ষী সবাই আদালতে উপস্থিত থাকলেও হয়তো আইনজীবীদের সে সময় আদালতে পাওয়া যায় না। তাই আদালতে বিচারক সংখ্যা বৃদ্ধি করলেও এ সমস্যা অব্যাহত থাকলে মামলা জট খোলার সম্ভাবনা কম।

বাংলাদেশ পুলিশ অর্গানোগ্রামে কোর্ট পুলিশ বলে একটি শাখা রয়েছে। জেলা পর্যায়ে এক জন পুলিশ পরিদর্শক ও মেট্রোপলিটন পুলিশে একজন অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার কিংবা সহকারি পুলিশ কমিশনার এ ইউনিট পরিচালনা করে থাকে। বাংলাদেশে রুজুকৃত ফৌজদারি মামলাগুলো বিচারের জন্য প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে সিংহভাগ কাজ করে এ কোর্ট পুলিশ। সবচেয়ে বড় কথা ছিল ২০০৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত নিম্ন আদালতে কোর্টের সাব-ইন্সপেক্টরগণ সরকারি আইনজীবীর ভূমিকা পালন করত। তদন্তাধীন মামলায় গ্রেফতারকৃত আসামীদের ব্যাপারে আদালতে নথি উপস্থাপন, রিমান্ডের আবেদন শুনানিতে তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন কোর্ট সিএসআইগণই করত।

কোর্টের পুলিশের আর একট গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসা সরকারি পক্ষের সাক্ষীদের হাজিরা নিশ্চিত করা, তাদের নাম ঠিকানা আদালতে নথিভুক্ত করা। এ ক্ষেত্রে তারা সরকারের পক্ষে সাক্ষ্য দিতে আসা সাক্ষীদের আদালতে গাইড হিসেবে কাজ করত। কিন্তু বর্তমানে সকল প্রকার মামলা পরিচালনার ভার  রাজনৈতিক বিবেচনায় অস্থায়ীভাবে নিয়োজিত এপিপি/পিঁপিঁদের হাতে। কিন্তু কোর্ট পুলিশ আর সরকারি কৌসুলিদের মধ্যে সমঝোতার অভাব, ভূমিকার অস্পষ্টতা, সর্বোপরি অস্থায়ীভাবে নিয়োগকৃত সরকারি কৌসুলিদের অবহেলা, অদক্ষতা ও অস্থায়িত্বের জন্য আদালতে মামলার জট শুধু বিচারিক পর্যায়েই নয়, তদন্ত ও আমলী পর্যায়েও বিস্তৃত হয়েছে। আবারো কবি গুরুর প্রশ্ন

''কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে, বাঁশি সংগীতহারা,
অমবস্যার কারা
লুপ্ত করেছে আমার ভুবন দুঃস্বপ্নের তলে।
তাই তো তোমায় শুধাই অশ্রুজলে---
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আসুন আমরা প্রত্যেকেই যার যার জায়গা থেকে আইনি সেবা প্রার্থীদের সেবা নিশ্চিত করি এবং জেলা আইনগত সহায়তা কার্যক্রমকে সকল নাগরিকের মাঝে ছড়িয়ে দেই  যাতে আপোষ-মীমাংসা, দ্বন্দ্ব নিরসনে, প্রভাবশালীদের শোষণ নির্যাতন নিপীড়নের হাত হতে শোষিত ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা প্রদানে ন্যায়বিচার অবারিত ও নিশ্চিত হতে  পারে ।



তথ্যসুত্র-
1. Agnes, Flavia, „Violence against Women: Review of Recent Enactments‟ in Swapna
Mukhopadhay (eds), In the Name of Justice: Women and Law in Society (Delhi, 1998) 80
2. Aliaga, Mertha and Brenda Gunderson, „A Definition of Qualitative Method‟ in Mark
Balnaves and Peter Caputi Introduction to Quantitative Research Method (Sage Publications
Limited, 2001)
3. Ameen, Nusrat, „Law and the State‟s Response towards Violence against Women‟ (2000) 4
Bangladesh Journal of Law 27
Chowdhury, Elora H, „Negotiating State and NGO Politics in Bangladesh: Women Mobilize
against Acid Violence‟ (2007) 13 Violence against Women 857
4. Chowdhury, Jamila A, „Women‟s Access to Fair Justice in Bangladesh: Is Family Mediation
a Virtue or Vice‟ in Chowdhury, Jamila A, „Legal Aid and Women‟s access to Justice in
Bangladesh‟ (2012) 1 International Research Journal of Social Sciences 8
5. Cresswell, John W, „Research Design: Qualitative, Quantitative, and Mixed Methods
Approaches‟ (Sage Publications, 2009)
6. Ellsberg, Mary and Lori Heise, Researching Violence against Women: A Practical Guide for
Researchers and Activists (Washington DC, United States: World Health Organization,
PATH, 2005)
7. Farouk, Sharmeen A, „Violence against women: A statistical overview, challenges and gaps
in data collection and methodology and approaches for overcoming them‟ (2005) Expert
Group Meeting, UN Division for the Advancement of Women in collaboration with Economic
Commission of Europe and World Health Organization, Switzerland 11-14