আমাদের ছোটবেলা আর এখনকার থার্ড জেনারেশনের
ছোটবেলার মধ্যে বিস্তর তফাৎ, এখন তাদের স্মৃতিতে কোন দৌড় ঝাপ নেই, ছোটাছুটি নেই ,
বাসার পাশে বিশাল মাঠ নেই, বৃষ্টিতে ভিজে মাঠে কাদায় পানিতে ঝুপাঝুপির ফুটবল খেলা
নেই , নদীতে সাতার কাটা গোছল করা এসব কোনকিছুই নাই । স্কয়ার ফিটের চার দেয়ালের মাঝে তাদের বিচরন , ভার্চুয়াল স্ক্রিন আর ইন্টারনেট গেমিং এর মধ্যে এরা বেড়ে উঠছে । অথচ আমরা কি স্বর্নসময়ের শৈশব পাড় করেছি । যা
আজো ভাবলে নস্টালজিক একটা অনুভুতি তৈরি হয় ।
আমরা থাকতাম কলোনীতে , যেখানে ছিল বিশাল
মাঠ, আম্রকানন আর ছোট একটি নদী , আহা কত সাধের সেই সময়গুলি । প্রতিদিন বিকেলে আমরা
ফুটবল খেলতাম, সন্ধ্যা হবার আগেই মাঠ ছেড়ে বাসায় গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসতাম ।
কলোনীর দেওয়ালে দেওয়ালে শোভা পেত বড়
অক্ষরে লেখা-AKC-আবাহনী ক্রীড়া চক্র আর MSC- মোহামেডান
স্পোর্টিং ক্লাব , কি যে মধুর প্রতিযোগিতা
! ফ্ল্যাগ জার্সি সব খানেই এই দুই দলের প্রতিযোগিতা , সালাউদ্দিন, আসলাম, মুন্না
,কায়সার হামিদ এরা ছিল আমাদের সময়ের হিরো , ভিউ কার্ডে তাদের ছবি ছিল বিশেষ কাটতি
। শুক্রবার দিন বিকাল ৩টায় থান্ডার ক্যাটস ছিল খুব উপভোগ্য , বুধবার ছিল-ম্যাগগাই বার
! ম্যাগাইভার ঐ সময়ের জনপ্রিয় টিভি সিরিজ , এছাড়া দি ফল গাই , টারজান ছিল খুব
জনপ্রিয় । আর ছিল সেই বিখ্যাত রেসলিং যার নায়ক ছিল মাইকেল ইগু , নীল মাস্কারাস ,
এরা কোনদিন হয়ত জানতেও পারেনাই যে বাংলাদেশের মত ছোট একটি দেশ যার বেশিরভাগ নাগরিক
আবেগপ্রবন ও হুজুগের পাগল সেই দেশে তারা এতটা জনপ্রিয় ।
আর বিশ্বকাপের বদৌলতে ম্যারাডোনা তখন সব শ্রেনীর সব বয়সের মানুষের সুপার
হিরো । আমাদের বাসায় কাজের ছেলের নাম ছিল ফিরাজুল কিন্তু আমরা তাকে টারজান বলে ডাকতাম । সে টারজানের
মত –ও ও ও ও ডাক দিতে পারত আর গাছ
থেকে গাছে ঝুলে উড়ে যেতে পারত । এই টারজানের রাজ্যের সব প্রশ্ন থাকত আমাদের দুই
ভাই এর কাছে , জিজ্ঞেস করত ম্যারাডোনার কথা ,
ভাইয়া-
ম্যারাডোনা কি ভাত খায় ? ম্যারাডোনা কি বাথরুম করে ? ম্যারাডোনা হিন্দু না
খ্রিস্টান ? নকল ম্যারাডোনা নাকি আছে ?
তো আমরা দুই ভাই তাকে মনের মাধুরী মিশিয়ে বানিয়ে বানিয়ে বিচিত্র ধরনের
উত্তর দিতাম , আমরা বললাম – ম্যারাডোনারা দুই ভাই , ম্যারাডোনা আর ত্যারাডোনা ,
ত্যারাডোনা বড় এই ত্যাড়ডোনাই ম্যারাডোনার মত দেখতে , মাঝে মাঝে ম্যারাডোনার জায়গায়
ত্যরাডোনা খেলে ! এরপরে ক্যামেরুনের খেলোয়ারদের দেখলে বলত ভাইয়া - মিলার নাকি কাঁচা মাংস খায় ? কুকুরও নাকি খায় ?
আমরা বলতাম না সে শুকরের মাংস খায় হালকা সিদ্ধ করে । মানে তার কোন প্রশ্নই আমরা
সাড়া না দিয়ে থাকতাম না , বানিয়ে বানিয়ে একটা কিছু বলে দিলেই হত । উল্লেখ্য যে
টারজান আমাদের সমবয়সী ছিল , তাকে দিয়ে আমরা মাঠের লাইন তৈরি, গোলপোষ্ট তৈরি , ফুটবল
এ পাম্প দেয়া এসব কাজ করত । আমার বন্ধুরা মুসা, বুলেট, রানা আমরা এই টারজান কে
সবাই নানা ফরমায়েশ দিতাম ।
আমরা তখন নাইনে কি টেনে পড়ি, ফুটবল আমাদের দিন রাতের সারাক্ষনের খেলা , কলোনীতে আমাদের দু এক ব্যাচ সিনিয়র ও জুনিয়রদের নিয়ে একটা ফুটবল
টুর্নামেন্ট ছাড়া হল । ৪ টা দলের খেলা ,
আমাদের পুরো কলোনীর ছোট বড়দের সমন্বয়ে দল গুলো করা হল , ৪ টা দলের মোট ৬ টি খেলা ।
আমরা আমাদের হেভিওয়েট মুসা ইব্রাহিমের নেতৃত্বে একটা দল গঠন করলাম এবং এন্ট্রি ফি
২০০ টাকা , আমরা ২০ টাকা করে চাঁদা দিলাম
। এই চাদার টাকায় প্রতিদিনের খেলার আপ্যায়ন, মাইকের ভাড়া এবং ফাইনাল খেলার মেডেল ও
কালো রঙের সেই সময়ের বিখ্যাত শিল্ড কেনা ।
যথারীতি খেলার উদ্বোধন হল , সারা কলোনীতে মাইক দিয়ে ঘোষনা আর ফাকে ফাকে গান
, ওহুও সারারা সারারা অঊ অঊ প্রিয়াগো তোমার কথা ভেবে ভেবে ---
বিপ্লবের গান , এছাড়া সেই সময়ের জনপ্রিয় বাংলা সিনেমার গান – তোমাকে দেখলে
একবার মরিতে পারি শত বার – গান বন্ধ সাথে সাথে ভাষ্যকার রফিকুল – গুটি গুটি পায়ে
এগিয়ে যাচ্ছে নুর ইসলাম বাবু বাধা দিচ্ছেন বুলেট
, দেখা যাক কি হয় , দুর্ঘটনার আশংকা , কিন্তু না বিশাল কিক এ বল পাড় করে
দিলেন বিপদসীমানার বাইরে !
আবার কখনো কখনো মাঠ চলে গেল বলের বাইরে ,কর্দমাক্ত আকাশ আর মেঘমুক্ত মাঠ !
দ্বিতীয় দিনের খেলায় আমাদের দল , প্রচণ্ড উদ্দীপনা আর টান টান উত্তেজনায় খেলা চলছে , মাইকে সেই আগের মতই গান আর ধারাভাষ্য , ভাষ্যকার রফিকুল –সাপের মত ফণা তুলে হেড করেছেন মুকুট কিন্তু না রেফারির হুশিয়ারি বাঁশি, অফ-সাইড ! দুই শূন্য গোলে আমরা জিতে গেলাম , সেকি আনন্দ আর উদযাপন , মাঠের মধ্যে চরকির মত ডিগবাজি আর হিপ হিপ হুররে ।
পাঁচ পাঁচটি ম্যাচের পরে সেমিফাইনালে জিতে আমাদের দল ফাইনালে গেল , কিন্তু বিপক্ষের দল বেশি শক্তিশালী, কি করা যায় ?
আমরা পুরো-দল মিলে নদীর তীরে গেলাম গোপনে মিটিং করতে সাথে আমাদের সেই টারজান ও আছে , রুস্তম, মাহাবুব, আজাদ, মশিউর , নিপুন ,মাসুম, নিয়ন সবাই আছি , খুব টেনশন সবার মধ্যে আগামীকালের ফাইনাল খেলা নিয়ে । হড়াৎ করে টারজান বলে উঠল- ভাইয়া আমার কাছে একটা জাদুর মন্ত্র আছে , এই মন্ত্র তিন রাস্তার মোড়ে একটা বড় ইঁদুর মেরে সেই ইঁদুরের উপর দিয়ে ইঁদুরের হাড় নিয়ে গোল পোষ্টের মাঝখানে পুতে রাখতে হবে তাহলে গোলকিপার আর বল ধরতে পারবেনা , সব বল পোষ্টে ঢুকবে আর গোল হবে,
আমরা সবাই মন্ত্রমুগ্ধের মত টারজানের কথাগুলো গিলছিলাম , বললাম –ইঁদুরের গায়ে মন্ত্র দিবে কে ? সে বলে –ভাইয়া মন্ত্র আমি জানি শুধু তিন রাস্তার মোড়ের ইঁদুর লাগবে , কাল বিলম্ব না করে আমরা ৩ টি দলে ভাগ হয়ে গেলাম তিন রাস্তার যে কয়টা মোড় আছে তার সাথের ঝোপে ইঁদুর ধরতে ,
সন্ধ্যা হয়ে গেল , কেউ ইঁদুর পাচ্ছে না , এরমধ্যে আমাদের এক চাচা জিজ্ঞেস করলেন- এই তোমারা এইখানে কি খোজ? আমাদের মহা-বন্ধু বুলেট বলে উঠল –কাকা আজাদের আংটি এখানে পড়েছে সেটা খুজতেছি ।
অবশেষে রাত ১০টার দিকে ইঁদুর পাওয়া গেল , সেকি আনন্দ আমাদের , ইঁদুর দেয়া হল টারজান কে , টারজান তার সব জাদু টোনা মন্ত্র শেষ করে রাত বারটার দিকে মাঠের উত্তর দিকের গোল পোষ্টের মাঝে সেই জাদুর হাড় গেড়ে আসল , এখন প্রশ্ন হচ্ছে –আমাদের দল যদি টসে আগে ঐ গোলপোস্ট পড়ে তবে গোল রক্ষক কৌশলে ঐ জাদুর হাড় উঠিয়ে ফেলবে এবং হাফ টাইমের সময় ওটা আবার কৌশলে গেড়ে রাখবে ।
পরের দিন বিকালে সাজ সাজ রব রব অবস্থা , ফাইনাল খেলা আর আমরা মানসিকভাবে ধরে নিয়েছি যে আমরাই চ্যাম্পিয়ন আমরাই সেরা , টসে সেই গোল পোষ্ট বিপক্ষের দলের পড়েছে আমরা আরও খুশি ! কিন্তু হায় , বিধিবাম তিন চারটা কিক গোলরক্ষক ধরে ফেললেন, মাঠ থেকেই কটমট করে শুধু টারজানের দিকে সবাই তাকায় ।
জাদু মন্ত্র টোনার কল্যাণে আমরা ৫ টি গোল খেলাম এবং শোচনীয় হার যাকে বলে গো-হারা হারলাম । খেলা শেষ হওয়া মাত্রই বন্ধু মাসুম উড়ে গিয়ে টারজান কে মারছে , আমি আর আমার ভাই টিটু ধরে ফেললাম যাতে আর মারতে না পারে , টারজান হাউমাউ করে কাঁদছে আর বলছে আর একটা মাইর দিলে ভাইয়া – সত্যি আমি এই জাদুর কথা সবাই কে বলে দিব ! আমরা চুপ হয়ে শুধু তাকে বললাম কেউ মারবেনা , তুই বাসায় যা ।
এরপরে আমরা রানার্স আপের পুরস্কার নিয়ে সবাই মনমরা হয়ে নদীর ধারে বালুর উপর খালি গায়ে শুয়ে থাকলাম , মনে হচ্ছে জাদুর ছু মন্তর ছু আমাদের সবাই কে ছুঁয়েছে ।
চমৎকার একটি লেখা। আমাদের ছোট বেলাটা এমন ই ছিল। বর্তমান প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের এসব লেখা পড়া উচিত, কেমন ছিল আমাদের সময়টা, কেমন ছিল আমাদের স্বপ্নের পুরুষরা, আমাদের স্বপ্নের নায়কেরা, আমাদের স্বপ্নের খেলোয়ার রা। অনেক ধন্যবাদ দেওয়ান লালন আহমেদ।
উত্তরমুছুনআপনাকেও ধন্যবাদ পড়বার জন্য ,
উত্তরমুছুনnice sir
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
উত্তরমুছুনস্মৃতিকাতর হলাম।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ লেখনী।
ধন্যবাদ লালন ভাই চমৎকার এই লেখাটির জন্য।