বুধবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৭

জয় হে মাটি ও মানুষের নেত্রী




দেওয়ান লালন আহমেদ 


জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে বঙ্গবন্ধু কন্যা
তব শুভ নামে জাগে, তব শুভ আশিস মাগে,
গাহে তব জয়গাথা।
জনগণমঙ্গলদায়ক জয় হে বঙ্গবন্ধু কন্যা
জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে ।

ভারতের জাতীয় সংগীত জনগণমন-অধিনায়ক জয় হে
রচয়িতা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রচনাকাল   ১৯১১ । পাঁচ স্তবকের গানটির প্রথম স্তবকটি ১৯৫০ সালে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সংগীতের স্বীকৃতি লাভ করে। আজ বঙ্গবন্ধু কন্যা মহামান্য জননেত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে দেশ, দেশের মানুষের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে চলেছেন, দেশের মান বিশ্বের কাছে হিমালয়সম করে তুলেছেন, দেশকে নানা ক্ষেত্রে সাফল্য এনে দিচ্ছেন, কবিগুরু বেঁচে থাকলে হয়ত এভাবেই বঙ্গবন্ধু কন্যাকে নিয়ে লিখতেন

১.
১৯৯৫ সালের ঘটনা তখন  কলেজে পড়ি পিতার কর্মস্থল ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস। সেই সুবাদে আমরা তখন ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস কলোনিতে থাকি । বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা  তখন  পঞ্চম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতাআমাদের কলোনির পাশেই সুগার মিলের নয়নাভিরাম অতিথিভবন যার সামনে বিশাল ফুলের বাগান আর অনেক বৃক্ষরাজির সমাহার । কোলাহলমুক্ত নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশের এই অতিথিভবন নানা কারণে সকলের মন টানত । সেই সময় হঠাৎ দেখি একটা সাজ সাজ আড়ম্বরপূর্ণ অবস্থা কারণ এখানে একদিনের জন্য অতিথি হবেন জাতীয় সংসদের তৎকালীন বিরোধীদলের আপোষহীন, সংগ্রামে-আন্দোলনে দূরদর্শী নেত্রী শেখ হাসিনা

আমাদের কলোনির একেবারেই কাছে হওয়ায় অতিথি ভবনে সবসময়ই আমাদের অবাধ যাতায়াত ছিল এবং এর স্টাফরাও ছিল আমাদের অতি পরিচিত । যথারীতি ক্ষণে তিনি এলেন। আমরা বন্ধুরা মুসা ইব্রাহীম (প্রথম এভারেস্টজয়ী), রানা, তৌফিক এবং  মাসুম ভেতরে গেলাম । মাত্র কিছুক্ষণ হয়েছে তিনি এসে পৌছেঁছেন। আমরা এই নন্দিত আপোষহীন নেত্রীকে অনেক কাছাকাছি দেখার সুযোগ হাতছাড়া করলাম না । তিনি ভিআইপি রুমে বসলেও দরজা খোলাদেখলাম ওনার গাড়ির ড্রাইভারকে ডাকলেনবললেন- তুই খেয়েছিস? যা খেয়ে নেএর পর তার সঙ্গের এক সহকারি যিনি গাড়ি থেকে বাক্সপেটরা নামাচ্ছিলেন, তাকে ডেকেও একই কথা বললেন – তুই খেয়েছিস ? যা খেয়ে নে

পরে জেনেছিলাম সেই সহকারীর নাম ‘জাহাঙ্গীর’উপস্থিত সকলেই আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো পুরো বিষয়টা দেখছিলাম এবং এই মাতৃসুলভ আচরণে এই মহান নেত্রীর প্রতি ভীষণভাবে প্রণোদিত হলামপুরো ঘটনার সাধারণ্যে উপলদ্ধি হলো, তাঁর পক্ষেই কেবল মাটি ও মানুষের কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব ।  এর পর স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে তিনি বৈঠক করছেননানানজনের নানা সমস্যা শুনছেনআমরা এরই ফাঁকে এই মহান নেত্রীর সঙ্গে ছবি তুলে ফেললামআফসোস, সেই ছবিটি হারিয়ে গেছে। কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে আছে, সেদিন অফ হোয়াইট এক পাঞ্জাবি পরেছিলাম

২.
২০০৯ সালের নভেম্বর মাসবিপিএটিসিতে দীর্ঘ চার মাসের ৪৪তম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শেষ হলো। সনদ বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আসবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ।  আর অনুষ্ঠান শেষে তিনি প্রশিক্ষণ সম্পন্নকারী সকল কর্মকর্তাদের  সঙ্গে চা পানে অংশ নেবেন । দোতলার হল রুমে এজন্য একটু উঁচু করে একটা স্টেজের মতো তৈরি করা হয়েছে যেখানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বসবেন এবং চা পানে অংশ নেবেন । সকল কর্মকর্তাদের জন্য বসবার ব্যবস্থাও সেখানেই রয়েছে।

যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান তাই আমাদের সবাইকে বারবার ড্রিলে অংশ নিতে হয়েছে যাতে প্রধান অতিথির সামনে একটি দাপ্তরিক সৌজন্যতা প্রদর্শিত হয় নির্ধারিত দিনে তিনি এলেন। এসএসএফ, পিজিআর ও বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক পরিবেষ্টিত আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নির্ধারিত আসন ছেড়ে চায়ের কাপ হাতে নিচে নেমে এলেন। আমরা সবাই তাজ্জব বনে গেলাম। তিনি আমাদের মাঝে ঢুকে পড়লেনআমাদের সকলের প্রিয় সহকর্মী আসমা সিদ্দিকা মিলিকে জিজ্ঞেস করছেন – এই তুমি কেমন আছ? তোমার শরীর কেমন এখন ? তিনি মিলি আপার পরিবারের অন্যান্যদের খোঁজ নিলেনএছাড়া তিনি হাঁটছেন আর বিভিন্ন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করছেন – বাড়ি কোথায়? কোন ক্যাডার? মনে হলো- আমাদের মা-খালারা যেভাবে আমাদের ও পরিবার-পরিজনদের খোঁজখবর নেন, তিনি আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও ঠিক তেমনিভাবে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেনতিনি সহজেই মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন আর এ জন্যই তিনি বিমানে ভ্রমণরত অবস্থায়  সাধারণ যাত্রীদের খোঁজখবর নেন, কথা বলেন এবং কোনো মূমুর্ষূ মায়ের সেবায় নেমে পড়েন, শিশুদের আদর করেন, কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানএটাইতো আমাদের মায়েরা করেন এটাইতো আপামর বাঙালী জাতির মায়ের নিদর্শন। আর এটা শুধুই সম্ভব একজন আদর্শ, মমতাময়ী, বিনয়ী এবং পারিবারিক মূল্যবোধসম্পন্ন শুদ্ধতম বাঙালি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার পক্ষেকবিগুরু বেঁচে থাকলে হয়ত তাঁকে নিয়ে এভাবেই লিখতেন–

‘পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থা, যুগ-যুগ ধাবিত যাত্রী।
হে চিরসারথি, তব রথচক্রে মুখরিত পথ দিনরাত্রি।
     দারুণ বিপ্লব-মাঝে  তব শঙ্খধ্বনি বাজে
                   সঙ্কটদুঃখত্রাতা।
জনগণপথপরিচায়ক জয় হে বঙ্গবন্ধু কন্যা!
   জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে’


    

জনগণমঙ্গলদায়ক

--তুমি আসলে কে?
গ্রীক পুরান থেকে খসে পরা কোন দেবী?
নাকি মমতাময়ী মা? নাকি পাশের বাড়ির ভরা মাটির কলসী হাতে আমার হাসুবু?
নাকি সারা দুনিয়ার ক্ষমতাধর প্রধানমন্ত্রী?
তুমি হাজার কোটি সাধারণ বাংগালীর একজন না?
আর কতো ভাবে তুমি আমাদের কাছে সুন্দর হবে? 
(সংগৃহীত)            
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর  টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন এই মহীয়সি নেত্রী পিতা শেখ মুজিব তখন কলকাতায় ভারতভাগের পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতি, দাঙ্গা প্রতিরোধ এবং লেখাপড়া নিয়ে মহাব্যস্ত দাদা-দাদীর স্নেহ-আশীর্বাদ নিয়ে তাঁর জীবন শুরু হয় দাদাই তার নাম রাখেনহাসিনা জন্মের খবর পেয়ে পিতা একদিন হঠাৎ বাড়ি এসে মেয়েকে কোলে তুলে নিয়েহাচুমণিডেকে আনন্দ প্রকাশ করে কপালে চুম্বন এঁকে দিলেন সেদিনই তার ভাগ্যের লিখন তৈরি হয়ে যায় বঙ্গবন্ধুর সেই আদরের নয়নমণি ছোট্টহাচুমণিএকদিন বড় হয়ে বাংলাদেশের জনগণের প্রিয় নেত্রী হয়ে উঠলেন এবং ধীরে ধীরে বিশ্বনেত্রীর মর্যাদায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় এই হাচুমণিকে নিয়ে যে স্বপ্ন দেখতেন, তা হচ্ছে একদিন তার মেয়ে ইন্দিরা গান্ধীর মত একজন আদর্শবান নন্দিত নেত্রী হবেন । তিনি বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেনএর চেয়ে মহান আর কি হতে পারে?  নদী-নালা-খাল-বিলের স্রোতের শব্দ এবং সবুজ প্রকৃতি বুকভরা বিশুদ্ধ বাতাস আর মাটির সোদাগন্ধ মেখে তার শৈশব কাটে
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পিতা-মাতা-ভ্রাতা-ভ্রাতৃবধূসহ পরিবারের সবাইকে হারিয়েছেন মাত্র ২৮ বছর বয়সে ঘটনাক্রমে দেশে না থাকায় কনিষ্ঠ সহোদরা শেখ রেহানাসহ তিনি প্রাণে বেঁচে যান। আকস্মিক কালবৈশাখী ঝড়ের মতোই তিনি জন্মদাতা পিতা-মাতাকে হারিয়েছেন। বাংলাদেশ হারিয়েছে জাতি-রাষ্ট্রটির স্থপতি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সে বছরের ৪ নভেম্বর কারাগারে একই খুনিচক্রের হাতে নিহত হন বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহকর্মী  চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামরুজ্জামান নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। সংবিধান, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ভেঙে পড়ে উবে  যায় উন্নয়নের স্বপ্ন দেশে তখন ঘোর অমাবস্যা। এমনই এক পটভূমিতে ১৯৮১ সালে তাঁর অনুপস্থিতিতে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দীর্ঘ নির্বাসন থেকে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে শিশুপুত্র-কন্যাকে ফেলে দেশের ডাকে, জাতির প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন তিনি। ইতোমধ্যে তার আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালনেরও ৩৪ বছর পূর্ণ হয়েছে। দুই দফায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন পূর্ণমেয়াদে ১০ বছর। তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রিত্বের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন ১৯৮৬-৮৮, ১৯৯১-৯৫ এবং ২০০১-০৫ অর্থাৎ ১২ বছর। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তার রয়েছে ২৪ বছরের সংসদীয় অভিজ্ঞতা। অবশিষ্ট ১০ বছর কেটেছে সমগ্র দেশ চষে বেড়ানোয়, দেশকে, দেশের মানুষকে ও দেশের আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা বোঝার লক্ষ্যে পঠন-পাঠন (Learning Process) এবং নিজেকে জনগণের যোগ্য নেতা হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তুতির কাজে। পাশাপাশি অব্যাহত রেখেছেন স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম, কারা নির্যাতন ভোগ, গৃহবন্দি/অন্তরীণ এবং বারবার জীবন বিপন্ন করে জাতিকে জাগিয়ে তোলার সাধনা। বাংলাদেশের মতো দারিদ্র্যপীড়িত ও ভঙ্গুর গণতান্ত্রিক একটি দেশকে উন্নয়নের পথে, মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করে একটি সমৃদ্ধিশালী শান্তিপূর্ণ জনপদে পরিণত করা কীভাবে সম্ভব এটাই ছিল শেখ হাসিনার চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু। বস্তুত বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী আদর্শ এবং বাংলাদেশের বাস্তবতা থেকে উৎসারিত হয়েছে শেখ হাসিনার দেশ-ভাবনা ও উন্নয়ন-দর্শন। জীবনের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা, অনুশীলন এবং দেশের মানুষের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকেই শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনায় তার অগ্রাধিকারগুলো ঠিক করেছেন।

সংগ্রামমুখর বর্ণাঢ্য তার জীবন। পরিবারের সবাইকে হারানোর এই  শোক তাকে শক্তিশালী দায়িত্বশীল করেছে    এবং উজ্জীবিত করেছে  দেশের জন্য মানুষের জন্য কাজ করে যেতে তিনি কাজের প্রতি যথেষ্ট আন্তরিক। বিরোধীদলের নেত্রী হিসেবে  তার আপোষহীনতা, সংগ্রামে-আন্দোলনে দূরদর্শী। আবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দুবার দায়িত্বভার পালন কালেও  দেখা গেছে  যথেষ্ট সচেতন থাকতে, ভালো-মন্দ ঘটনা যাই ঘটুক শেখ হাসিনা অবশ্যই জানতে পারেন, জানতে পারলে একটা সুরাহা তিনি নিজেই বের করে তার সমাধান না হওয়া পর্যন্তু মনিটরিং করে থাকেন। নিজেই সমাধান করার চেষ্টা করে থাকেন। এখানেই তার একনিষ্টতার পরিচয় পাওয়া যায়। তার কাছে দেশ ও দেশের মানুষ হলো প্রধান কথা। এর বাইরে তিনি যেতে চান না, যেতে পারেন না
তার মধ্যে বই পড়ার নেশা, রাজনীতিমনস্ক হয়ে ওঠা, মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে সাহায্য করা। অত্যন্ত বিনয়ী এবং শুদ্ধতম বাঙালি হয়ে ওঠার পেছনেও তাদের একটা পারিবারিক মূল্যবোধ আছে সত্য, তারপরও পিতা-মাতার প্রভাব শেখ হাসিনাকে একজন আদর্শ, মমতাময়ী মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা এনে দিয়েছে
লেখক হিসাবেও জননেত্রী শেখ হাসিনার অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ। তাঁর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে: ) শেখ মুজিব- আমার পিতা (আগামী প্রকাশনী, বই মেলা ২০১৫); ) ওরা টোকাই কেন? (১৯৮৭); ) বাংলাদেশে স্বৈরতন্ত্রের জন্ম (১৯৯৩); ) দারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু ভাবনা, (১৯৯৩); ) আমার স্বপ্ন, আমার সংগ্রাম (১৯৯৬); ) People and democracy (১৯৯৭); ) আমরা জনগণের কথা বলতে এসেছি (১৯৯৮); ) বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়ন (১৯৯৯); ) সামরিক তন্ত্র বনাম গণতন্ত্র (১৯৯৯); ১০) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন (২০০১); ১১) বিপন্ন গণতন্ত্র, লাঞ্ছিত মানবতা; ১২) সহেনা মানবতার অবমাননা (২০০৩); ১৩) Living with tears; এবং ১৪) সাদা কালো

শেখ হাসিনা আজ অভিজ্ঞতায় টইটম্বুর, অভিজ্ঞতার আলোকে অনেক শক্তিশালী। প্রখর বুদ্ধিমত্তা, সহনশীলতা দৃঢ়তা, ধৈর্য্য, যেন তাঁর চরিত্রগত ধর্ম। ভালোবাসায় সহমর্মীতায় তিনি সকলের কাছে ভীষণ প্রিয় এবং সকলের অতি আপনজন। তাই আজ আমাদের কাছে গর্বের বিষয় শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে জনগনের কাছে নন্দিত

জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক
বিডিআরবিদ্রোহ দমনকালে তাঁর ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তা আমাদের মনে আছে। তার রাষ্ট্রনায়কোচিত বক্তব্য, জ্ঞান, আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে এটা আমাদের কাছে অনেক বড় প্রাপ্তি। বাঙালি হিসাবে, একজন নারী হয়েও তিনি আমাদের মাথা উঁচু করেছেন যা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয়নি
শেখ হাসিনা বাঙালি জাতির কান্ডারী হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন তাঁর মেধা, সাহস সততার কারণে বর্তমান বাংলাদেশের অস্তিত্বের প্রতীক বলা হয় তাঁকে স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাঙালির জাতিসত্ত্বা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মূল্যবোধ নস্যাৎ করতে সর্বাত্বক চেষ্টা চালিয়েছিল তাদের সঙ্গে মহা উৎসাহে যোগ দিয়েছিল ক্ষমতালোভী সুবিধাভোগী রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ব্যবসায়ী সমাজ বঙ্গবন্ধুর বাঙালি জাতি তখন ছিল অসহায়, নির্যাতিত, অপমানিত, নিপীড়িত ধর্মের দোহাই দিয়ে বাঙালির চিরশত্রু পাকিস্তানের স্বৈর-সামরিক শাসকরা দেশকে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন গর্তের ভেতর ফেলে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে ভেঙ্গে চুরমার করে এক জঙ্গী সাম্প্রদায়িক শাসন কায়েমের ভিত রচনা করেছিল যেহেতু লোভী বিশ্বাসঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর পবিত্র রক্ত মেখে নিজেরাই হয়েছিল ঘাতক খুনী, তাই সেই ভিত শক্তিশালী হতে পারেনি তাদের পাপী হৃদয়ের লালসা চরিতার্থ করতে পারেনি খুনী মোশতাক-জেনারেল জিয়া জেনারেল এরশাদ বাঙালির অস্তিত্বকে মুছে ফেলার অপচেষ্টা চালিয়েছিল এসব তো আমরা চোখের সামনে দেখেছি তাদের উচ্ছিষ্টভোগী লোভীরা কেউ কেউ তলে তলে তাদেরই সমর্থন করে গেছে। বাঙালি তথা বাংলাদেশ তখন বিশ্বে মাথা নিচু করেই ছিল ক্যূ, পাল্টা-ক্যূ, গুম হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের অপচেষ্টা, গণতন্ত্র এবং রাজনীতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র চলছিল সুশাসনকে বুটের তলায় নিষ্পেষিত করে দুর্নীতি দু:শাসনের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছিল একদিকে মুষ্টিমেয় উচ্ছিষ্টভোগীরা ধনী থেকে ধনী হচ্ছিল, আর একদিকে গরীব আরও গরীব হয়ে পড়ছিল দারিদ্র-দুর্ভিক্ষ অভাব অনটনে মানুষ আরও অসহায় হয়ে পড়ছিল মুক্ত বাতাস নেবার মতো পরিবেশ ছিল না দেশে কবির ভাষায় -
‘ও আলোর পথযাত্রী, এ যে রাত্রী
এখানে থেমোনা
এ বালুচরে আশার তরণী তোমার
যেন বেঁধোনা
আমি শ্রান্ত যে, তবু হাল ধর
আমি রিক্ত যে, সেই সান্তনা,
তব ছিন্ন পালে জয় পতাকা তুলে,
সূর্য তোরণ দাও হানা

আন্তর্জাতিক অঙ্গনের অনেক সংস্থা, বিশেষত বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ-তহবিল, পশ্চিমা বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান এবংবাংলাদেশ বিশেষজ্ঞদের কাছে বাংলাদেশের উন্নতিটা একটা ধাঁধার ব্যাপার। বাংলাদেশের এই উন্নয়ন ধাঁধা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল এবং বিশ্বের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদদের অনেকেই (ব্যক্তিগত অথবা যৌথভাবে) বাংলাদেশের অগ্রগতিতেবিস্ময়প্রকাশ করেছেন। উন্নয়ন ধাঁধা এবং বিস্ময় অর্থনীতি নিয়ে যে দেশ-বিদেশের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মাথা চুলকানো এবং গবেষণা চলছে, তাতে অন্তত এটুকু প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশ অনুন্নয়নের ফাঁদ ভেঙে বেরিয়ে এসেছে।

তবে, ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের এককালীন কর্মকর্তা Just Faland এবং J.R. Parkinsion তাদের রচিত ‘The Test Case for Development’ শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেছিলেন, ‘বাংলাদেশ হলো উন্নয়নের প্রশ্নে পৃথিবীর কঠিনতম সমস্যা। যদি বাংলাদেশের সমস্যা সমাধান করা যায়, তা হলে মোটামুটি নিশ্চয়তার সাথে বলা যেতে পারবে যে, পৃথিবীর অন্য যে কোনো দেশেরও উন্নতি সম্ভব, এবং সে কারণে বাংলাদেশকে বলা যেতে পারে উন্নয়নের বৈতরণী।ওরা বেঁচে আছেন কি-না জানি না। বাংলাদেশ যেউন্নয়নের চ্যালেঞ্জমোকাবিলা করেউন্নয়নের বৈতরণীপার হতে সক্ষম হয়েছে, নিঃসন্দেহে তা নিয়ে আজ আর কোনো বিতর্ক নেই। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও বিশিষ্ট বামপন্থি চিন্তক এমএম আকাশ ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর একটি দৈনিকে যে প্রবন্ধ লিখেছিলেন, তা থেকে বলা যায়-
“বাংলাদেশকে এখন মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ পশ্চিমা দেশগুলি উদীয়মান অর্থনীতির দেশ নামে অভিহিত করছেন। নতুন বাঘ হওয়ার সম্ভাবনা আছে তার। এর কী লক্ষণ? লক্ষণ হচ্ছে, আমাদের তৈরি পোশাকশিল্প এখন বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে চলে গেছে। লক্ষণ কী? লক্ষণ হচ্ছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে (হালনাগাদ ৩২ বিলিয়ন ডলার) লক্ষণ কী? লক্ষণ হচ্ছে কৃষিখাতে খাদ্যশস্য উৎপাদনে বাংলাদেশ কেবল স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়নি, চাল রপ্তানির কথাও ভাবতে পারছে। লক্ষণ হচ্ছে, কৃষিমজুরি ভরা মৌসুমে দিনে ৪০০ টাকায় পৌঁছেছে আর চাহিদা যখন কম থাকে অর্থাৎ, হাল্কা মৌসুমে কোনো স্থানেই ১৫০ টাকার নিচে কাউকে নিয়োগ করা যায় না। মোটা চালের দাম ৩০ টাকা ধরলেও সর্বনিম্ন মজুরি দিয়ে অন্তত ৫ কেজি চাল কেনা যায়। সম্ভাবনার বাংলাদেশের আরও লক্ষণ হচ্ছে নিয়মিতই রাস্তায় দেখা যায় যে রিকশাচালক নিজের রিকশায় আয়েশী ভঙ্গিতে বসে মোবাইল ফোনে কথা বলছে। লক্ষণ হচ্ছে বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে ৪ কোটি ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করছে, যাদের প্রত্যেকের হাতে বছরের প্রথম দিনই নতুন একসেট পাঠ্যবই তুলে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। অমর্ত্য সেনের মতো নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ বিভিন্ন সময়ে তার বক্তৃতায় স্বীকার করেছেন যে কতিপয় সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ভারতের চেয়েও এগিয়ে রয়েছে। আমাদের দেশে দারিদ্র্য হ্রাস পেয়েছে। মঙ্গা দূর হয়েছে। উপজেলা কেন্দ্রগুলোতে অকৃষিখাতে নানা ধরনের ছোটখাটো উদ্যোগ গড়ে উঠেছে। গ্রামের ও শহরের নেটওয়ার্ক বেড়েছে। আমরা অর্থনীতিবিদরা এ ধরনের পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে বলি- বিমানটি এখন আর ঘড়ঘড় শব্দ করে ইঞ্জিনে শক্তি সঞ্চয় করবে না, সোজা উড়ে যাবে (টেক-অফ)
বাংলাদেশের মিরাক্যাল ইকোনমির ধাঁধার উত্তর খুঁজে পেতে হলে তাকাতে হবে বাংলাদেশের তথা মূলধারার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং দলনেত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শনের দিকে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পেছনে যে প্রেরণা কাজ করেছে, তা থেকেই উৎসারিত হয়েছে এই উন্নয়ন দর্শন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই প্রথম সেই রূপরেখাটি আমাদের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছিলেন। আমাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। সেখানে আরও বলা হয়েছে, মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যকেই সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া হবে। সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি প্রসঙ্গে মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা সম্পর্কিত ১৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদন শক্তির ক্রমবৃদ্ধিসাধন এবং জনগণের জীবনের বস্তুগত ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতিসাধন যাহাতে নাগরিকদের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, যুক্তিসংগত অবকাশকে ও সামাজিক নিরাপত্তার অধিকারপ্রভৃতি নিশ্চিত হয়। আর ১৯() () অনুচ্ছেদে সকল নাগরিকের সুযোগের সমতা, মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ ও সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর উন্নয়ন দর্শনকে আরও সুস্পষ্ট ভাষায় আমাদের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যেমন অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, তেমনি তাঁর বিভিন্ন ভাষণে, বক্তব্যে ও বাস্তব কর্মকান্ডে প্রতিফলন ঘটিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন দারিদ্র্য, শোষণ, বঞ্চনা ও সমাজে ভেদ-বৈষম্য থাকলেস্বাধীনতা অর্থহীনহয়ে পড়বে। একটি হৃদয়গ্রাহী রূপক দিয়ে তিনি বলতেন, ‘আমার দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে হবে।বলতেন, “ক্ষুধা-দারিদ্র্য ও পশ্চাৎপদতামুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধসোনার বাংলাগড়ে তোলাই তার জীবনের একমাত্র কামনা।শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর এই অভেদমন্ত্র এবং দুখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোকেই তার জীবনবেদ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। ক্ষমতার বাইরে থাকতেই তিনি বাংলাদেশের উন্নয়ন-দর্শন নিয়ে তার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনাকে সমৃদ্ধ করেন।
শেখ হাসিনা তাঁরদারিদ্র্য দূরীকরণ: কিছু চিন্তাভাবনাগ্রন্থে লিখেছেন: দারিদ্র্য বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা এবং সে কারণেই এ দেশের জন্য যে কোনো উন্নয়ন-কৌশলের প্রধান লক্ষ্য হিসেবে দারিদ্র্য দূরীকরণকে চিহ্নিত করতে হবে।আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে, গণতন্ত্রের স্থিতিশীলতা অনেকখানি নির্ভর করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অবস্থার উন্নতির ওপর। আমাদের সমাজের বৃহৎ জনগোষ্ঠীই হচ্ছে দরিদ্র ধনিক গোষ্ঠীর সংখ্যা তার তুলনায় অত্যন্ত ক্ষুদ্র। কাজেই গণতন্ত্র যদি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য অর্থবহ না হয়ে ওঠে, কেবল ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে, তা হলে জনগণের কল্যাণ সাধন হবে না।
বাংলাদেশের প্রধান সমস্যাটিকে চিহ্নিত করা এবং সেই সমস্যা সমাধানের সাথে গণতন্ত্রের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে শেখ হাসিনার এই উপলব্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গিই তাকে আজকের বাংলাদেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অনুপ্রাণিত করেছে। কেবল ভিক্ষা করে বা ভিক্ষা দিয়ে অর্থাৎ দারিদ্র্য নিরসনে, তাঁর ভাষায়, ‘অনুদান বা ঋণ বিতরণ বা খয়রাতি সাহায্য হিসেবে কর্মসূচি গ্রহণ করলে চলবে না। জাতীয় উন্নয়ন ও উৎপাদনের লক্ষ্যকে সামনে রেখে স্থায়ীভিত্তিতে কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।দারিদ্র্য দূরীকরণে বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ ও কর্মসূচি বিষয়েও তার দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত পরিষ্কার। একই গ্রন্থে তিনি এ প্রসঙ্গে লিখেছেন: দারিদ্র্য যেহেতু বহুমাত্রিক একটা সমস্যা, সেহেতু শুধুমাত্র দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় এবং কর্মসংস্থান বাড়ালেই চলবে না, তার খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষমতাও বৃদ্ধি করতে হবে। বাড়াতে হবে তার অধিকার-সচেতনতা, তার সংগঠন করার ক্ষমতা, স্থানীয় পর্যায়ে স্ব-শাসিত সরকারের (Local Self Government) কার্যক্রমে তার অংশগ্রহণের মাত্রা।
শেখ হাসিনা উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনকেই উন্নয়নের প্রধান বা একমাত্র মাপকাঠি মনে করেন না। ১৯৯৩ সালে লেখা তাঁর এই গ্রন্থেই তিনি স্পষ্ট করেছেন। লিখেছেন, ‘প্রথমত, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হার নিশ্চয়ই আমাদের অর্জন করতে হবে। কিন্তু শুধু এটুকু বলাই যথেষ্ট নয়। উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য অনেকগুলো বিকল্প পন্থা (কর্মসূচি) হতে পারে। আমাদেরকে সে কর্মসূচিই বেছে নিতে হবে, দারিদ্র্য দূরীকরণের Potentials যার সবচেয়ে বেশি। দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য প্রবৃদ্ধির কোন উপাদানগুলো সর্বাধিক গুরুত্বসম্পন্ন তা শনাক্ত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রধানত অর্থনৈতিক সামাজিক সুনির্দিষ্ট এজেন্ডা এবং তা বাস্তবায়নের নির্ধারিত সময়সীমা সম্বলিত ধরনের কর্মসূচি অতীতে কখনও নেওয়া হয়নি। কর্মসূচিতে যেমন ৫টি অগ্রাধিকারের ক্ষেত্র নির্ধারণ করা হয়, তেমনি ২০২১ সালকে সামনে রেখে একটা রূপকল্পও দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করা হয়। এই রূপকল্পে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে, ২০২১ সালে, আমরা কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই, তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীকালে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তোলার অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়। এই নির্বাচনী ইশতেহারের ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইশতেহার প্রণীত হয়। এই ইশতেহার আসলে ২০০৮ সালের ইশতেহার বা কর্মসূচির বর্ধিত রূপ। অর্জিত সাফল্য আস্থার ভিত্তিতে ঘোষণা করা হয় ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে।
১৬ কোটি মানুষের বিপুল জনসংখ্যার দেশ বাংলাদেশ। Just Falandদের আশঙ্কাকে অমূলক প্রমাণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ। দারিদ্র্যের লজ্জা ঘুচিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের সাফল্যের নতুন কোনো ফিরিস্তি দেওয়া আমি নিষ্প্রয়োজন মনে করি। পেশাদার অর্থনীতিবিদ না হয়েও রাজনৈতিক অর্থনীতি আমি যেটুকু বুঝি তাতে দৃঢ়তার সাথেই বলতে পারি, যে কোনো অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়ন কর্মকান্ডের পেছনেই একটা দার্শনিক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করে। উন্নয়নের এজেন্ডা কী হবে, অগ্রাধিকার কী হবে, সম্পদ বণ্টনের নিরিখ কী হবে, আশু দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য কী হবে এবং সর্বোপরি পুরো উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দল জনগণের ভূমিকা কী হবে, তা নির্ধারণ করেন রাজনৈতিক নেতৃত্ব। এখানে জনগণ ইতিহাসের নির্মাতা হলেও রথের রশি টানেন যে সংগঠিত বাহিনী বা দল, আর যে দলকে পরিচালনা করেন যে রথী যিনি পথনির্দেশ করেন, তাদের ভূমিকা বাদ দিয়ে তো ইতিহাস অচল। ইতিহাসের নির্মাতা জনগণকে সংগঠিত পরিচালিত করেন দল রাজনৈতিক নেতৃত্ব। অতএব, বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়ন অভিযাত্রার রূপকার শেখ হাসিনা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের মিরাক্যাল অর্থনীতির ধাঁধার উত্তর পাওয়া যাবে না।



জনগণপথপরিচায়ক
২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল - এই কালপর্বে অর্থাৎ শেখ হাসিনার দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার প্রধানমন্ত্রিত্বের কালে উন্নয়নের দৌড়ে বাংলাদেশ অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বর্তমান সরকারের সাফল্য এবং বাংলাদেশের অর্জন সম্পর্কে যদি কারও সন্দেহ থাকে, তা হলে তাদের এম নিয়াজ আবদুল্লাহ (অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়), অ্যান্টোনিয়ো স্যাভোয়য়া (ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়), ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ (ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপ, বাংলাদেশ) লিখিত ‘Path to Development : Is there a Bangladesh Surprise’ প্রবন্ধটি পাঠের অনুরোধ করব। প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল, ‘World Development, Vol. 62, PP. 138-154, 2014..’ বাংলাদেশের এই অত্যাশ্চর্য সাফল্যের রহস্য উদ্ঘাটনে দেশ-বিদেশের অর্থনীতিবিদগণ শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের উন্নয়ন দর্শন এবং রাজনৈতিক মতাদর্শগত অবস্থানের উল্লেখ ছাড়া, আর সব কিছুই বলেছেন। অনেক পান্ডিত্যপূর্ণ এবং একাডেমিক আলোচনা এখনও অব্যাহত আছে। স্থূল, হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত মিথ্যাচার এবং অপব্যাখ্যা যে নেই, তা নয়। তবে মূলধারার অর্থনীতিবিদ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো Surprise Development সম্পর্কে একমত।
এহেন কালে কবিগুরু হয়ত উন্নয়নের কাণ্ডারী শেখ হাসিনাকে নিয়ে এভাবেই লিখতেন–
‘ঘোরতিমিরঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে
জাগ্রত ছিল তব অবিচল মঙ্গল নতনয়নে অনিমেষে।
     দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে   রক্ষা করিলে অঙ্কে
       স্নেহময়ী তুমি মাতা।
    জনগণদুঃখত্রায়ক জয় হে বঙ্গবন্ধু কন্যা
     জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয় জয় হে’’

১৯৯৬ সালে নির্বাচিত হয়ে রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণের পর দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং উন্নয়নের যে নীতি-কৌশল তিনি গ্রহণ করেছিলেন তাতে তাঁর সেই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছিল। উৎপাদনশীল কৃষির বিকাশে এবং খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনের লক্ষ্যে তিনি সেচ সম্প্রসারণ, সেচ ও সারের ওপর ভর্তুকি প্রদান, সহজ শর্তে কৃষি ঋণের প্রাপ্যতা নিশ্চত করা, বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি ও গ্রামীণ বিদ্যুতায়নকে অগ্রাধিকার প্রদান, গ্রামীণ অবকাঠামো গড়ে তোলা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ার কথা মনে রেখে তিনি ও তার সরকার বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বিদ্যমান পোশাক শিল্পের সমস্যার সমাধান করে তার বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, স্যানিটেশন প্রভৃতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ফলে বাংলাদেশে একদিকে প্রবৃদ্ধির সূচক যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি অন্যদিকে সামাজিক খাতের অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ওই সময়েই বাংলাদেশ প্রথম খাদ্যে আত্মনির্ভরশীলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছায়।
অতীতের তুলনায় দারিদ্র্য হার হ্রাস পেতে থাকে ৩ গুণ হারে। দেশের ইতিহাসে প্রথম বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, আশ্রয়ণ, ঘরে ফেরা এবং একটি বাড়ি একটি খামার কর্মসূচি চালু হয়। গড়ে ওঠে প্রায় ১২ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক। হত-দরিদ্র মানুষের দোরগোড়ায় প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মঙ্গা দূরে চলে যায়। গ্রামীণ জীবনের একটা গুণগত পরিবর্তন সূচিত হয়। তথ্যপ্রযুক্তি খাত করমুক্ত করে দেওয়া হয়। পোশাক শিল্পে প্রণোদনা, এর বিকাশকে তরান্বিত করে। সিমেন্ট শিল্পে দেশ আত্মনির্ভরশীল হয়। সম্ভাবনাময় গ্রামীণ শিল্প পোল্ট্রি প্রভৃতি গড়ে উঠতে শুরু করে। বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। খাদ্য ও পুষ্টি ক্ষেত্রে উন্নতির কারণে জাতিসংঘ খাদ্য সংস্থা (FAO) শেখ হাসিনা সরকারের প্রথম মেয়াদেসেরেসপদকে ভূষিত করে। শেখ হাসিনার উদ্ভাবনী বিভিন্ন দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচি এবং দরিদ্রবান্ধব বহুমুখী কর্মকান্ডের ফলে ১৯৯৬-২০০১ পর্বে অনুন্নয়নের ফাঁদ ভেঙে বাংলাদেশ বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়। গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ৬ শতাংশে উন্নীত হয়। দারিদ্র্য হ্রাস পায় ১.৫০ শতাংশ হারে। মূল্যস্ফীতি ১.৫৯ শতাংশে নেমে আসে। মানুষের গড় আয়ুষ্কাল বেড়ে ৬৭ বছরে উন্নীত হয়। জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে একটি প্রগতিশীল নারীনীতি প্রণীত হয়। প্রণীত হয় শিক্ষানীতি। শিক্ষার হার দ্রুতলয়ে বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। কিন্তু উন্নয়নের এই ধারাবাহিকতা আবার মুখ থুবড়ে পড়ে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি-জামাত জোট ক্ষমতাসীন হয়। দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং জঙ্গিবাদের উত্থান রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়ায় উন্নয়নের গতি অতি দ্রুত শ্লথ হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অনুন্নত বা উন্নয়নকামী দেশের পর্যায় পেরিয়ে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর প্রথম সারিতে উন্নীত হয়েছে। এখন বাংলাদেশ বিস্ময় অর্থনীতির দেশ এবং বিশ্বের চোখে উন্নয়নের ধাঁধা। বস্তুত একটা উত্তরণকাল অতিক্রম করছে বাংলাদেশ। এটা রাতারাতি হয়েছে এমন দাবি করা যাবে না। উন্নয়ন অভিযাত্রায় আশির দশক থেকেই বাংলাদেশ হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে চলছিল। তবে কথিতবিস্ময়করধাঁধাহতে নব্বইয়ের দশক থেকে আরও দুই দশক অপেক্ষা করতে হয়েছে। ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগদিনবদলের সনদশীর্ষক একটি নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করে। রাষ্ট্র পরিচালনায় ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরের প্রত্যক্ষ এবং মধ্যবর্তী বিএনপি-জামাত এবং দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনকালের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে শেখ হাসিনাডিজিটাল বাংলাদেশগড়ে তোলার লক্ষ্যে এই দিনবদলের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এই কর্মসূচিতে প্রকৃতপক্ষে তার উন্নয়ন দর্শনই অভিব্যক্ত হয়। স্মর্তব্য যে, শেখ হাসিনা ১৯৯৯ সালের ৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার লেখাবৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য উন্নয়নশীর্ষক একটি প্রবন্ধে রাজনীতি ও উন্নয়নের আন্তঃসম্পর্ক কী হওয়া উচিত, ব্যাখা করেন। এই প্রবন্ধে শেখ হাসিনা একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করে লেখেন-
আমাদের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় কিছু পরিবর্তন আনা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। ক্ষমতায় আরোহণের জন্য আমাদের দেশে সাধারণত রাজনৈতিক ইস্যুকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে। সমাজ সংস্কার বা অর্থনৈতিক কর্মকান্ডকে ইস্যু করা হয় না।তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি আমাদের রাজনীতির একটা পরিবর্তন প্রয়োজন। প্রতিযোগিতা হতে হবে জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি। আন্দোলন হবে সমাজ সংস্কারের জন্য, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য। আর এ উন্নয়ন মুষ্টিমেয় মানুষের জন্য নয়। এ উন্নয়ন অবশ্যই হতে হবে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য।আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা আছে। এই সম্পদ যদি কেউ বেশি পরিমাণে দখল করে তা হলে অন্য কেউ বঞ্চিত হয়। তার ভাগে কম পড়ে। কাজেই সম্পদের সুষম বণ্টন প্রয়োজন। কেউ খাবে কেউ খাবে না তা হবে না। সকলের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। রাজনীতিতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে।রাজনীতি হতে হবে ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে। দেশকে আমরা কী দিতে পারলাম সেটাই একজন রাজনীতিবিদের চিন্তা-ভাবনা হতে হবে। দেশ কী দিল তা বড় কথা নয়। দেশের জন্য, মানুষের জন্য কতটুকু করতে পারলাম সেটাই বড় কথা। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে জনকল্যাণমুখী কর্মসূচি নিয়ে। আজকের প্রতিযোগিতা হতে হবে অর্থনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে। সামাজিক কর্মসূচি নিয়ে
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে গ্রেফতার-নির্যাতন সত্ত্বেও শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগ এই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একটুকুও বিচ্যুত হননি। বরং নির্বাচনী ইশতেহারে তার এই রাজনৈতিক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং উন্নয়ন দর্শনই প্রতিফলিত হয়। ইশতেহারে আশু অর্থাৎ নির্বাচিত হলে পাঁচ বছরে কী করা হবে তা এবং দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে তার একটি রূপরেখা তুলে ধরা হয়।


জনগণদুঃখত্রাত্রী
২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে শেখ হাসিনা জাতিকে স্বপ্নদর্শী করে তোলার পাশাপাশি একুশ শতকের প্রযুক্তি উপযোগী হবার আহ্বান জানান। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার সকল কর্মসুচি তৃণমূল থেকে শুরু করেন। দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং তার সরকারের অধীনে নিরপেক্ষ স্বচ্ছ নির্বাচন করে তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথকে উদার করে দিয়েছেন। এর পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি কর্মসংস্থানের ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে দেশকে আজ মডেল হিসেবে বিশ্বনেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণে সমর্থ করে তোলেন। এছাড়া তার শাসনামলে নারীর ক্ষমতায়নও বিশ্বে এক বিশেষ উদাহরণ স্থাপন করেছে। শেখ হাসিনার প্রতি তাকিয়ে আছে শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়া দরিদ্র অনুন্নত দেশের মানুষও। বর্তমান বিশ্বে যখন অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, দেশে দেশে মূল্যবৃদ্ধি বেকার সমস্যা জটিল হচ্ছে তখন তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছেন। মানুষের জীবিকা নির্বাহে ন্যূনতম উপায় সৃষ্টি করেছেন। শেখ হাসিনার কৃতিত্ব এখানেই তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি হচ্ছে তিনি গভীর আন্তরিক বলেই যেকোনো ভালো উদ্যোগকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করতে জানেন। বিশেষ করে কৃষি খাতের উন্নয়নে তাঁর কোনো বিকল্প আজও আমরা দেখতে পাই না। জাতীয় অর্থনীতি আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী। দারিদ্রের হার অনেক কমে বর্তমানে ৩২.০৫ ভাগে নেমে এসেছে। অনেক রকম সমস্যা আছে দেশে, সমস্যার মাত্রাও নানাবিধ তারপরও দেশের মানুষ ন্যূনতম শান্তি স্বস্তিতে জীবনযাপন করছে। এর প্রধান কারণ দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি। আমাদের স্বীকার করতেই হবে শেখ হাসিনার শাসনামলে তার দৃষ্টি তৃণমূল থেকেই ওপরে উঠেছে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী কার্যকর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অব্যাহত উন্নয়ন ধারার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক . মাহাথির মোহাম্মদ সম্প্রতি  মালয়েশিয়ার পূর্তজায়ায় নিজ অফিসে বাংলাদেশের কয়েকজন ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক কালে তিনি প্রশংসা করেন সম্প্রতি আধুনিক মালয়েশিয়ার জনক মাহাথির মোহাম্মদ এর পূর্তজায়ায়ফারডানা লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনে কার্যালয়ে তাঁর নিজস্ব অফিসে এক বৈঠকে এসব কথা বলেন
মাহাথির মোহাম্মদ বলেন, আমার পক্ষে মালয়েশিয়াকে ২২ বছরে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা যত সহজ ছিল, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তা অনেক কঠিন হবে। কারণ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি আর মালয়েশিয়ার জনসংখ্যা কোটি ৭০ লক্ষআয়তনের দিক দিয়ে মালয়েশিয়া তিনগুন বড়তিনি আরও বলেন, আমাদের (মালয়েশিয়ায়) মধ্যে রাজনৈতিক মতপার্থক্য আছে। কিন্তু রাজনীতির নামে ভায়োলেন্স নেই। ৯০ ভাগ মুসলিম অধ্যুষিত বাংলাদেশে ইসলামের ভুল ব্যাখা দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য জঙ্গী হামলা চালাচ্ছে কিছু ভ্রান্ত মানুষ। যা উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনার ভিশন বাস্তবায়নের জন্য অন্তরায়
তবে তিনি বিশ্বাস করেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্ব দৃশ্যমান উন্নয়নের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিশ্বের অধিকাংশ উন্নত দেশগুলো বাংলাদেশে ইতিমধ্যে বিনিয়োগ করে উন্নয়নে বিশাল ভূমিকা রাখছেবৈঠকে মাহাথির মোহাম্মদকে জানান হয় যে ,বাংলাদেশকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্র করার জন্য নিরলস কাজ করছেন। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে একাধিক দেশীয় জঙ্গী হামলার ঘটনায় অনেকে মনে করেছিল বিদেশী বিনিয়োগ থমকে যাবে, কিন্তু তা হয়নি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের একটি আন্তর্জাতিক দরপত্রে বিশ্বের ২১ টি দেশের কোম্পানী অংশগ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণে জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তে মানুষের মনবল বেড়ে যায় বহুগুণ, বিশ্বব্যাংক বলতে বাধ্য হয়েছে পদ্মাসেতু নিয়ে বিশ্ব ব্যাংকের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলে বৈঠকে আলোচনা করেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা

নারীর ক্ষমতায়নে গৃহীত বিভিন্ন কর্মসুচি এবং সন্তানের অভিভাবক হিসেবে সর্বক্ষেত্রে পিতার পাশাপাশি মায়ের নামের স্বীকৃতিও ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। দেশে প্রথম নারী সচিব নিয়োগ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতেই হয়েছিল। তাঁর শাসনামলেই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন পদে আসীন হয়েছেন নারীরা। প্রথম মহিলা সচিব তাঁর হাত দিয়েইপ্রথম এসপি মহিলা, টিএনও হলো, মহিলা ওসি - তিনি এসব নিয়োগ দিতে শুরু করেন
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা  বলেন, ‘আপনারা খেয়াল করে দেখুন, উচ্চ আদালতে কোনো মহিলা জজ ছিল না। প্রথম মহিলা জজ হাইকোর্ট ডিভিশনে, পরে অ্যাপিলেট ডিভিশনে। সেটাও আওয়ামী লীগেরই করা। বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর পদে কোনো মহিলাকে দেওয়া যায়, সেটা কেউ ভাবতেই পারত না। সেখানেও আমরা পৌঁছে গেছি।
বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়নের জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম তৃণমূল পর্যায় থেকে নেতৃত্ব গড়ে উঠুক। প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিলাম, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। সে জন্য মেয়েদের ৩০ শতাংশ কোটা সুনির্দিষ্ট করলাম। কিন্তু মেয়েরা দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভোট চাইবে? এটা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। অনেক বাধা এলোঅথচ ৪৫ হাজার মেয়ে সেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল ১২ হাজার সিটের (আসন) জন্য। যারা বাধা দিয়েছিল, তারাই আবার কুপিবাতি বা পাটখড়িতে আগুন দিয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে ওই মেয়েদের পক্ষে ভোট চাইলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘একইভাবে আমরা মেয়েদের খেলাধুলার ব্যবস্থা করেছি। প্রথমবার যখন দেশে প্রমীলা ফুটবলের আয়োজনের চেষ্টা করা হয়, তখন অনেকের বাধার মুখে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তবে এখন সেসব বাধা কেটে গেছে। এখন আমাদের মেয়েরা ক্রিকেট খেলছে, ফুটবল খেলছে।
একইভাবে জাহাঙ্গীরনগর ও বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) নারী উপাচার্য নিয়োগ করার কথা জানান শেখ হাসিনা। এ সময়ও অনেক বাধা এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এসব বিশ্ববিদ্যালয় মেয়েরা আরো ভালো চালাচ্ছে।

তিনি তরুণদের কাছে প্রযুক্তি ব্যবহারের অবাধ সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করেছেন। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাসোপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছেন যেখানে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মসংস্থান ছাড়াও সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের বিরাট সম্ভাবনা থাকবে। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা শেখ হাসিনার কতটুকু অর্জিত হয়েছে জানি না, তবে তাঁর মতো জনদরদী মমতাময়ী নেত্রী ভবিষ্যতে আসবে কি না সেটা ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মই মূল্যায়ণ করবে

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যোগ্য উত্তরসুরী হিসেবে শেখ হাসিনা তার সততা, আত্মত্যাগ, দূরদর্শীতা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন এটাই হচ্ছে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব

শিখা যেমন আকাশের পানে উঠে যাচ্ছে, আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে, ‘আয় উঠে আয়’, ওপরে আরও ওপরে আমরাও যাব ওপরে, থেমে যাবো না, উঠব আমরা উন্নতির শিখরে। বাঙালি জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে উন্নত জাতি হিসেবে। বিশ্বসভায় স্থান করে নেবে সম্মানের।




তথ্যসুত্রঃ
-   শেখ হাসিনা, আমরা আলোর পথযাত্রী, রচনা সমগ্র, পৃ. ২৪২
-   মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার রূপায়নে শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শন - নূহ-উল-আলম লেনিন
-   দেশ ও জাতির কল্যাণে সবার প্রিয় শেখ হাসিনা-বেবী মওদুদ 
-   গীতবিতান, প্রথম খন্ড, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বভারতী গ্রন্থনাবিভাগ
-   http://www.ptd.gov.bd/site/page/1d82e3c4-5b8c-4b80-a05a
-   http://www.bdmorning.com/others/57922

-   http://shomoyerkhobor.com/news-detail.php?id=41856#sthash.sY8XU3X3.dpuf

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন