শনিবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০২০

অদম্য নারীর গল্প – একটি সত্যিকারের জীবন যুদ্ধ ও একজন আসমা আরা রুচি







পুরাণ ঢাকার  বংশালের সাত রওজা এলাকা , এখানে গলির মাথায় একটি পাঁচ তলা বাড়ি , এই বাড়ির মালিক বড় মসজিদের ইমাম মাওলানা সাকের উদ্দিন , তার মেয়ে ছেলে কে নিয়ে এই বাড়িতে থাকেন , যৌথ পরিবার বলা যায় মেয়ের জন্য টি ফ্লাট এক মেয়ে বিদেশে থাকেন , আর ছেলেদের একটি করে ফ্লাট দেয়ার পর বাকী একটা তে বড় ছেলে ছেলের বউ সহ মাওলানা সাহেব থাকেন

 মাওলানা সাহেবের বড় মেয়ের এক ছেলে  এবং  তিন মেয়ে বড় ছেলে কোরানের হাফেজ টাইটেল পাস  ইরফান হাসান,  স্ত্রী সন্তান নিয়ে সৌদি আরবের মদিনাতে থাকেন এবং সেখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী করেন ।এরপরে  মেয়ে রেশমা আরা কচি  জগন্নাথ অর্থনীতি তে অনার্স ফাইনাল ইয়ার , তারপরে হাসনা আরা সুচি  রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ইডেনে দ্বিতীয় বর্ষে  অনার্স পড়েন আর একেবারে ছোট মেয়ে  আসমা আরা রুচি  বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে এখন ভর্তি শেষ হয় নাই


ইরফান , কচি ,সুচি এবং রুচি  তাদের বাবা  পানি উন্নয়ন বিভাগের  স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন , চাকুরীজীবন কেটেছে দক্ষিণ অঞ্চলের  বিভিন্ন জেলাতে সেই সূত্রে তার ছেলে মেয়েদের   একটা বড় সময় কেটেছে  মফস্বল শহরে বড় মেয়ে রেশমা আরা কচির  একাত্মা বান্ধবী হচ্ছে  দোলা দত্ত , ধর্মের তফাৎ ছাড়া তাদের আর কোন তফাৎ নাই, সারাক্ষণ তারা একসাথে ,  দোলা দত্ত  কে হঠাৎ করে কেউ দেখলে ভাববে যে সে কচিদের ফ্যামিলির মেম্বার

দুই পরিবারের এমন ঘনিষ্ঠতা সবাইকে মুগ্ধ করত
দোলা দত্ত রা এক ভাই এক বোন দোলার  ছোট ভাই  রাজীব দত্ত  কচির  মেজ বোন সুচির  বয়সী
এভাবে দুই পরিবারের মিথস্ক্রিয়ায় পূজা পার্বণ ঈদ সব খানে তাদের পারস্পরিক বন্ধন খুব গাড় ছিল


এভাবেই দিন যেতে যেতে  রুচি  ভর্তি হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন  বিভাগে সময়ের পরিক্রমাতে রুচি  তার বড়  আপুর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী দোলার ছোট ভাই রাজীবের সাথে প্রেমের বন্ধনে জড়িয়ে পড়ে যত দিন যায় তাদের এই প্রেম আরও গভীর হতে থাকে
  এভাবে চলতে চলতে একদিন তাদের প্রেমের বিষয়টি   দুই পরিবারই জেনে যায়  তখন  রুচি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ে ,  এমন চাপের মুখে তারা দুইজন অতি আবেগের বশে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলে 
যেহেতু তারা দুইজন দুই ধর্মের আর রাজীব ধর্ম পরিবর্তন করবেনা তাই তারা হিন্দু রীতিতে মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে , এই খবর শুনে রুচির রক্ষণশীল  পরিবার তাকে ত্যাজ্য ঘোষণা করে
রাজীব আর রুচি আজিমপুরে একটা ছোট বাসা ভাড়া নিয়ে থাকা শুরু করে , রুচি হল ছেড়ে দেয় তখন, এক বছরের মধ্যে তাদের একটি ছেলে সন্তান হয় , কিন্তু রাজীব এতদিনে যেমন করে আচরণ করত এখন তা ধীরে ধীরে পরিবর্তন হচ্ছে , তার বিশাল ব্যবসা বলেছিল আসলে তা তার দুলাভাই এর , প্রকৃত অর্থে সে বেকার , এই অবস্থায় ছেলের খরচ রুচির খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছিল ওদিকে  রুচির বাসা থেকেও কোন সাপোর্ট ছিল না ,

রুচি টিউশনি শুরু করল , ছেলে কে নিয়ে পড়াতে যেত এমনকি ভার্সিটিতেও ছেলে কে নিয়ে যেতে হত , শুরুতে এটা নিয়ে বিভাগে কথা উঠলেও পরবর্তীতে সবাই এটা কে মেনে নেয় , ছেলে মায়ের সাথে নিয়মিত ভার্সিটিতে যায়, রাজীব  ইদানীং তার বাসায় থাকছে রুচি কে একা একাই বেশি সময় আজিমপুরের বাসায় থাকতে হয়

রাজীব  মূলত বেকার কিন্তু সে আগে যা বলেছিল তা ছিল মিথ্যা , মেয়ের এমন স্ট্রাগল দেখে রুচির  নানা বাবা একটা প্রস্তাব দিল যে রাজীব  ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করুক তাহলে  আমরা তোমাদের মেনে নিবো।  রাজীব  শক্তভাবে বলে জীবনেও সে মুসলমান হবে না বরং রুচি  কে সে হিন্দু বানিয়ে বিয়ে করেছে , এমন দোটানা আর সম্পর্কের অবনতি তে এক পর্যায়ে রুচি  ডিভোর্স চায় কিন্তু রাজীব  বলে যে হিন্দু আইনে এটা সম্ভব না রুচি  আইনের আশ্রয় নেয় কিন্তু আদালত যখন তার কাছে তাদের বিয়ের কাগজ চায় তখন সে আসল বিষয়টা বুঝতে পারে , কারণ মন্দিরে গিয়ে পুরোহিত ঠাকুরের মন্ত্রে কপালে সিঁদুর দিয়ে বিয়ে যার কোন পেপার নাই 

হায় বিধি বাম, তার মানে আইনের চোখে ওদের বিয়েই হয়নি তাহলে এই ছেলে ?
 এরপরে রুচি কিছু  আইনগত সহায়তায় রাজীবের  সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে , কিন্তু এই ছেলে সহ রুচিকে তার  বাসায় তুলবেনা।

জীবন সাগরের অকুলে ডুবে যাচ্ছিল  রুচি ,  কোথায় যাবে কি করবে ??
এর মধ্যে তার চিন্তায় অসুস্থ হয়ে রুচির বাবা হার্ট এটাকে মারা যান , সব মিলিয়ে রুচি একেবারে ভেঙ্গে চুরে নিঃস্ব হয়ে যায় 

পরিস্থিতি মানুষ কে শেখায় , শক্ত করে গড়ে তোলে , ছেলে গল্প কে নিয়ে সে কিছুদিন বান্ধবীর বাসায় এরপরে কর্মজীবী হোস্টেলে উঠে ছেলে সহ , ছেলে গল্পের বয়স পাঁচ হয়ে গেছে , সারাদিন টিউশনি , বিসিএসের কোচিং এরপরে ছেলেকে সময় দেয়া এভাবে চলতে থাকে জীবন ,
জীবন যুদ্ধে পরাজিত না হয়ে সে দাড়াতে থাকে নিজের পায়ে , একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে  তার চাকুরী হয়   ছেলে কে নিয়ে ফ্লাটে উঠেছে , ভাল স্কুলে দিয়েছে ,সারাদিনের জব শেষ করে ছেলে কে নিয়ে সে রাতে খেতে বের হয় , কষ্টের দিন আস্তে আস্তে ফুরাতে ফুরাতে স্বপ্নের হরিণের দেখা পায়, বিসিএসে সিলেক্টেড এবং এখন সে সৎ -নির্ভীক ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দেশ জুড়ে নাম কামিয়েছে 
দেশের অবলা অসহায় নারীদের জন্য আসমা আরা রুচি  এক বিশাল অনুপ্রেরণা , রুচিদের জন্যই আজ দেশে নারীরা নিজের পায়ে দাড়াতে পারছে , নারী দিবস হোক এই সকল রুচিদের জীবন যুদ্ধে জিতে আসার সবচেয়ে বড় প্রতিপাদ্য
 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন